আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ ►
আমের বাণিজ্যিক রাজধানী বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত উত্তরের খাদ্যভান্ডার নওগাঁর আমগাছগুলোতে সবুজ পাতা ভেদ করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে আমের মুকুল। পাতা ঝড়া ফালগুন মাস এখনো আসেনি, শেষ হয়নি শীত। অথচ এরই মধ্যে নওগাঁর বিভিন্ন আম বাগানগুলোতে মুকুল আসতে শুরু করেছে। সবুজ পাতা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে আম চাষিদের সোনালী স্বপ্ন। কিছু দিনের মধ্যেই আমের মুকুলের মিষ্টি গন্ধে সুরোভিত হয়ে উঠবে প্রকৃতি। এসময়টাতে মুকুলের যতœ না নিলে আমের ভালো ফলন সম্ভব নয়। আর এ কারণেই আশায় বুক বেঁধে আমচাষিরা শুরু করেছেন পরিচর্যা। মুকুল যাতে পোকার আক্রমণ না হয় ও ঝরে না পড়ে সেদিকেই নজর রাখছেন আম চাষিরা।
নওগাঁ জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩০হাজার হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। যা গত বারের চেয়ে ৫২৫হেক্টর জমিতে আম চাষ বেশি হয়েছে। চলতি মৌসুমে উপজেলা ভিত্তিক আম চাষের পরিমাণ হলো সদর উপজেলায় ৫১০ হেক্টর, রাণীনগরে ১৩০, আত্রাইয়ে ১২০ দশমিক ৫হেক্টর, বদলগাছীতে ৫৩০হেক্টর, মহাদেবপুরে ৬৩০ হেক্টর, পতœীতলায় ৫ হাজার ৮১৫ হেক্টর, ধামইরহাটে ৬৭৫ হেক্টর, সাপাহারে ৯ হাজার ২৫৫ হেক্টর, পোরশায় ১০ হাজার ৫৫০ হেক্টর, মান্দায় ৪০০ হেক্টরও নিয়ামতপুরে ১ হাজার ৩৮৪ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে।
উত্তরের খাদ্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা বরেন্দ্র অঞ্চল নওগাঁ। নওগাঁর শুধু চালই নয় বর্তমানে এই জেলায় উৎপাদিত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট আমের কদর ও সুনাম দেশের গোন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও স্থান করে নিয়েছে। তবে এই আমচাষ নিয়ে সরকারের যুগ উপযোগি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আগামীতে এই অঞ্চলের আমকে বিদেশে ব্যাপকহারে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলেও মনে করছেন সচেতন মহল। এই জেলা এখন সারাদেশে আমের জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শুধুমাত্র সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা পেলেই নওগাঁকে আমের নতুন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা বর্তমানে সময়ের দাবী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। গতবছরও আমের রাজ্য হিসেবে পরিচিত রাজশাহী ও চাপাইয়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন জমিতে আমের চাষ হয়েছিলো। দিন দিন আমচাষ একটি লাভজনক ফসল হওয়াতে প্রতি মৌসুমে নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চলে আমের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নওগাঁর বিভিন্ন আমবাগান ঘুরে দেখা গেছে, বাগানের সারি সারি গাছে সবুজ পাতার মাঝে আমের মুকুল আসতে শুরু করেছে। সবচেয়ে ছোট ও মাঝারি আকারের গাছে বেশি মুকুল আসছে। গত এক সপ্তাহ আগে থেকেই গাছে মুকুল আসা শুরু হয়েছে। পুরোদমে মুকুল ফুটতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে বলছেন বাগান মালিকরা। তবে যে সব গাছে মুকুল আসছে কুয়াশা আর শীতের কারণে মুকুলের তি হওয়ার আশঙ্কা করছেন আম চাষিরা। তাইতো তারা শুরু থেকেই মুকুল ও গাছের পরিচর্যা শুরু করছেন।
সাপাহার উপজেলার চাচাহার গ্রামের আমচাষি খলিলুর রহমান বলেন, ১০০বিঘা জমি বিভিন্ন মেয়াদে লিজ নিয়ে আম বাগান করেছি। তাতে আ¤্রপালি, বারি ফোর, গৌড়মতি ও আশ্বিনা জাতের আম গাছ রয়েছে। এরমধ্যে কিছু আম গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। পুরোদমে মুকুল আসতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। তাই এসম গাছের বাড়তি যতেœর প্রয়োজন। ছোট-বড় আম বাগান পরিচর্যায় সময় ব্যয় করতে হয়। এছাড়াও বাগানের আগাছা পরিষ্কারসহ পোকা দমনে স্প্রে করা হচ্ছে কীটনাশক।
পোরশা উপজেলার আমচাষি মেহেদী বলেন, বর্তমানে নওগাঁর প্রতিটি অঞ্চলেই বাণিজ্যিকভাবে আমচাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এই আম প্রক্রিয়াকরনের জন্য আধুনিকমানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আম সংরক্ষণের জন্য হিমাপ্রায় স্থাপন করা হলে আমচাষীরা যেমন লাভবান হতেন তেমনিভাবে সরকারও সেই আমগুলো মানভেদে বিদেশে চালান করেও অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারতো। তাই এই অঞ্চলের আমচাষীদের দিকে সুদৃষ্টি প্রদান করতে আমি জেলার সকল আমচাষীদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিণ কর্মকর্তা এ,কে,এম মঞ্জুরে মাওলা বলেন, আবহাওয়াগত ও জাতগত কারণেই কিছু গাছে আগাম আমের এই মুকুল আসতে শুরু করেছে। এসব গাছে ফুল ফোটার আগে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। এতে করে পোকা-মাকড়েরর আক্রমণ কম হবে। তবে কোন ক্রমেই গাছে সেচ দেওয়া যাবে না। এতে করে নতুন করে পাতা জন্মাবে। এই জন্য চাষীদেরর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এখনও সবগাছে মুকুল আসেনি। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পুরোদমে গাছে মুকুল আসবে। তখন শীত কেটে যাবে। তখন আমের মুকুল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, নওগাঁর ব্রান্ড্রিং হচ্ছে জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলে উৎপাদিত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট আম। গতবছর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার সাপাহারে সঠিকভাবে আম বেচা-কেনা করা সম্ভব হয় এই জন্য বাজারের পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি সাময়িকভাবে আধুনিকায়নের কাজ করা হয়েছিলো। তবে আমরা আম উৎপাদিত অঞ্চলে একটি স্থায়ী আমবাজারের জন্য সরকারি জায়গার খোঁজ করে চলেছি। আশারাখি নির্দিষ্ট একটি আমের বাজার নির্মাণ করা হলে আমচাষী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আম কিনতে আসা ক্রেতাদেরও অনেক সুবিধা হবে। এছাড়াও আম সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার নির্মাণের বিষয়ে পদক্ষেপও চলমান রয়েছে। এছাড়াও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় আম মৌসুমে যেন নির্বিগ্নে পাইকাররা এসে নওগাঁ থেকে আম কিনতে পারেন সেই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের ভ’মিকাও ছিলো প্রশংসনীয়। আমি আশাবাদি এবারোও নওগাঁয় রেকর্ড পরিমাণ আম উৎপাদিত হবে এবং স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর তা দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।