সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর ►
২০১৪ সালের শুরুর দিক স্বামী ঊষা দেব শর্মা ৪ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। স্থানীয় এক ব্যাক্তির সহযোগিতায় একটি খাসি বাকীতে ক্রয় করে জবাই এর মধ্য দিয়ে কসাই এর পেশার যাত্রা শুরু হয়। এরপরই স্বামীকে সহযোগিতা করতে লক্ষী রানী শর্মা নিজেই এখন যুক্ত হয়েছেন কসাই মত পেশায়। এখন লক্ষী রানী শর্মা একাই ১০ থেকে ১৪টি খাসি ছাগল জবাই, চামড়া ছাড়ানো, মাংস কাটা, মাংস ওজন করা ও মাংস বিক্রির কাজ সকল দায়িত্ব নিজেই তিনি পালন করেন। ওজনে সঠিক এবং প্রতি কেজি ঘাটি খাসির মাংস বিক্রি করছেন ৭২০ টাকা দরে। দুই সন্তান ও পরিবার নিয়ে বর্তমানে স্বাবলম্ভী নারী কসাই লক্ষী রানী শর্মা।
নারী হয়েও নারী কসাই এর মত কঠিন পেশাকে বেছে নিয়েছেন লক্ষী রানী শর্মা এখন আলাচিত নাম ও সফল উদ্যোক্তাও বটে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ৪নং শহরগ্রাম ইউনিয়নের ফুলবাড়ী বাজারে লক্ষী রানী শর্মার মাংসের দোকান। শুধু স্থানীয় নয়, দুর দুরান্ত থেকে সনাতন ধর্মের মানুষেরা মাংস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তার দোকান থেকে। শুধু তাই নয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য মাংস কিনতে আগেই থেকেই সিরিয়াল দিয়ে খাসির মাংস ক্রয় করতে হয়। বিরলের ফুলবাড়ী বাজারের একটি দোকান ভাড়া নিয়ে প্রায় ৮ বছর ধরে খাসির মাংস বিক্রি করে আসছেন লক্ষী রানী শর্মা। স্বামী ঊষা দেব শর্মা বিভিন্ন হাটে হাটে ঘুরে খাসি সংগ্রহ করেন। মাঝে মধ্যে খাসি ছাগল ব্যবসায়ীরা খাসি ছাগল লক্ষী রানী শর্মার ফুলবাড়ী বাজারে মাংসের দোকানে এনেও বিক্রি করে যান।
প্রথম প্রথম বাড়ি থেকে সমর্থন ছিল না, সাথে আবার হিন্দু সমাজপতিদের গঞ্জনা, সকল কিছু উপেক্ষা করে স্বামীর সমর্থন আর নিজের সততা ও পরিচ্ছন্নতাকে পুঁজি করে কসাই এরমত পেশায় যুক্ত হন। এখন লক্ষী রানী শর্মার নাম জেলায়র বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষী রানী সর্ব নিম্ম ১০০ টাকারও খাসির মাংস করায় গরিব ও ধনী সকলেই মাংস ক্রয় করতে পারেন। এক দিনে সব্বোর্চ্চ ৩১ টি খাসির ছাগল জবাই করে মাংস বিক্রির রেকর্ড আছে। তাদের এখন এক ছেলে পড়াশোনা করে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে, চার বছর বয়সী মেয়ে বাড়িতেই নিচ্ছে শিশুশিক্ষা গ্রহণ করছে ।
নারী কসাই লক্ষী রানী শর্মা বলেন, এক সময় আমাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমার স্বামী এক সময় বিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে পারতেছিল না। স্থানীয় এক ব্যাক্তির সহযোগিতায় বাকীতে ছাগল ক্রয় করে। ঔ ছাগলটি ফুলবাড়ী বাজারে জবাই করে মাংস বিক্রি করে। এতে বেশ ভালই লাভ হয়। এরপর থেকেই স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য দোকানে আসা শুরু করি। আস্তে আস্তে ছাগল জবাই, চামড়া ছিলানো, মাংস কাটা, মাংস ওজন দেওয়া রপ্ত হয়ে যায়। এখন আমিই সব কিছুই পারি। আমার সাথে দুজন কর্মচারী রয়েছে। তাদেরকে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে হাজিরা দিতে হয়।
নারী কসাই লক্ষèী রানীর স্বামী ঊষা দেব শর্মা বলেন, এক সময় রিকশা চালিয়ে আমাদেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই আমার স্ত্রী লক্ষী রানী শর্মা আমাকে তার কিছু মুরগি ও কয়েকটি হাঁসের বাচ্চা, তার বাবার বাড়ী থেকে পাওয়া কিছু গহেনা ছিল আমাদের এক মাত্র সম্বল। সব কিছু বিক্রি করে ৮ হাজার ৩০০ টাকা আমার হাতে তুলে দেয়। এই হল আমাদের শেষ সম্বল এই নিয়ে কিছু কর। এই টাকা দিয়ে ছাগলের ব্যবসা শুরু করি। এক হাট থেকে ছাগল ক্রয় করে অন্য হাটে বিক্রি করি। এতে সামন্য লাভ হয়। এরপর একদিন হাট থেকে ক্রয় করা খাসি ছাগলটি ফুলবাড়ী বাজারে জবাই করি এবং মাংস বিক্রি এতে বেশ ভালই লাভ হয়। এলাকার মানুষের অনুপ্রেরনায় পরের দি;ন আরও একটা খাসি জবাই করি ও মাংস বিক্রি করি। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি ।এখন আমার স্ত্রী লক্ষী রানী এই ব্যবসা পরিচালনা করেন। আমি তাকে এখন সহযোগিতা করি।
লক্ষী রানী শর্মার দোকানে কর্মচারী গোবিন্দ রায় ও ইসমাইল ইসলাম জানান, লক্ষী রানী শর্মার মাংসের দোকানে হাজিরা ভিত্তিক কাজ করে এখন পরিবার পরিজন নিয়ে ভালই আছি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা হাজিরা পাচ্ছি। কাজের জন্য অন্য কোথাও যেতে হয় না। রবিবার , বুধবার ও শুক্রবারে ভির বেশি হয়। লক্ষী রানীর সাথে থেকে আমাদের সংসার ভালোই চলছে।
খাসি বিক্রেতা হায়দার আলী বলেন, দুরদুরান্ত থেকে খাসি ছাগল ক্রয় করে এনে লক্ষী রানী শর্মার নিকট ন্যায্য মূল্যে খাসি বিক্রি করতে পারি। খাসির ছাগলের দাম বাকী বকেয়া রাখে না লক্ষী রানী। তাই অনেক ছাগল পাইকাররা খাসি বিক্রি করে যান।
বিরলের দূর্গাপুর এলাকার সুভাষ চন্দ্র রায় বলেন, "এখানে খাসির মাংস বেশ ভালো। এজন্য আমরা এখানে কিনতে আসি। ওজন সঠিক ও দামও কম।"
ভাটপাড়া এলাকার মহেন চন্দ্র রায় বলেন, "আমি এখান থেকেই মাংস ক্রয় করি। সঠিক টাকা দিয়ে সঠিক মাংস পাই। তাই এখানেই নির্ভরতা আমাদের। নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে কাজ করলে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন হবে।
বোচাগঞ্জ থেকে আসা রবিন কুমার রায় বলেন, "অনেক লোক লক্ষ্ী রানীর কাছ থেকে মাংস কেনেন। বড় বিষয় হলো, গরীব-দুঃখী বা নিম্নআয়ের মানুষেরাও এখান থেকে মাংস ক্রয় করতে পারেন। এককেজি, আধাকেজি থেকে এক পোয়া, দুইশো বা একশো টাকার মাংসও বিক্রি হয় এখানে, যেন সবাই মাংস খেতে পারে।"
বিরল শহরগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াহেত আলী বলেন ,লক্ষী রানী একজন সাধারণ নারী। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসাবে খাসির মাংস ব্যবসা করেন এর জন্য সবাই তাকে প্রসংসা করেন। পরিষ্কার ও যত্নসহকারে লক্ষী রানী শর্মা মাংস বিক্রি করেন। ধীরে ধীরে সে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং মহিলা কশাই এই অঞ্চলে বিরল।