Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১-১১-২০২২, সময়ঃ দুপুর ০২:২৩

 হিসেব কষেও কাজ হচ্ছে না, ভোক্তার ভোগান্তি চরমে

 হিসেব কষেও কাজ হচ্ছে না, ভোক্তার ভোগান্তি চরমে

আশরাফুল আলম ►

বর্তমানে দেশ বিদেশ তথা আন্তর্জাতিক আলোচনা সমালোচনার বিষয়  নিত্য পণ্যমূল্যের উর্দ্ধগতি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম উর্দ্ধমূখী। কথাটা অনেকাংশে সত্যি হলেও কিছু দেশীয় মজুদদ্বার ও ব্যবস্থাপনার দায় দায়িত্বে থাকা কিছু মানুষের অযৌক্তিক  মন্তব্যও এর জন্য দায়ী। ভোক্তা অধিকার অনুযায়ী বহু পণ্যে এখন আর মূল্য নিদ্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত মুল্যের মধ্যে নেই সপ্তাহ যেতে না যেতেই একেক দরে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্য। নিয়ম অনুযায়ী পণ্য মুল্যের দর চাট না টানিয়েই বিক্রয় করা হচ্ছে পণ্য। বলতে গেলেই দোকানী বলছে দাম কখন যে ওঠা নামা করে মূল্য টানিয়ে বিপদে পরার মতো অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতা আছে বেশি বিপদে।

নিদ্দিষ্ট পণ্য কিনতে এক ধরনের বাজেট নিয়ে বাজারে গিয়ে এক ধরনের হতাশা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। কে শোনে কার কথা। যে কর্মকর্তাগণ এই অবস্থার উন্নতি কিংবা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়োগ প্রাপ্ত তারাও উচ্চ মূল্যে পণ্য কিনে নিরবে বাড়ি ফিরছে। সকলের দোহাই আন্তর্জাতিক বাজার অথবা ডলারের দাম চড়া। 

প্রতিটি পণ্যের মূল্য যে পরিমাণে বেড়েছে সেই পরিমানে কোথাও কোন মজুরী কিংবা বেতন কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। কোথাও কোথাও পরিবর্তিত হলেও মুল্য বৃদ্ধি তার উপরে উঠে গেছে। ফলে বেতন বৃদ্ধিতেও মধ্যবিত্ত অথবা সাধারণ পরিবারের কোন কাজে আসছে না। দরিদ্র দিন মজুর শ্রমিকের অবস্থা তো আরও করুণ। অনেক ব্যবসায়ি অধিক মুনাফা লাভের আশায় জনগনের জীবন নিরপত্তার কথা চিন্তা না করেই  প্রতিদিন ইচ্ছে মতো দাম বৃদ্ধিও প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেসকল পণ্যের মোরকে লেভেল রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে একটু রেহাই পেলেও মোরক বিহীন পণ্যের দাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম নীতির বালাই নেই। এই ধরুন কলা, কমলা, আঙ্গুর, পারুটি, মাছ, দুধ, স্যানিটারী প্যাড, সার্জিক্যাল পণ্য, বিভিন্ন ধরনের কাপড়, কাঁচা বাজার, ডিম, খেজুর, বিভিন্ন কসমেটিক্স, চকলেটজাত পণ্য, বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড আইটেমসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, নিমার্ণ সামগ্রী, কিংবা ইলেক্ট্রনিক ব্যবহারিত উপকরণ।

লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলছে দাম। মনে হয় যেন প্রতিদিন টেলিভিশনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখে দেখে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে। যুদ্ধে যেদিন যতো বেশি বোমা ফাটছে পণ্য মুল্য ততো আতংক হারে বাড়ছে। অন্যদিকে বুকফাটা শীতল আওয়াজে মাথায় দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দিন পারি দিতে হচ্ছে রিকসা ও অটো ভ্যান চালক, কুলি মজুরসহ বিভিন্ন নিম্ন পেশার মানুষ। এমন অবস্থার শিকার হয়ে অতি দরিদ্র কিংবা নিম্ন আয়ের এবং কোনো কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যের পুষ্টি চাহিদাও অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে যার ফলে একসময় এসব মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। 

অনেকের সুস্থ্য সবল দেহ নিয়ে বেড়ে ওঠাও চলেঞ্জিং হয়ে পরছে। দীর্ঘ সময় এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী প্রজম্মের সামনে বিপদের আশংকা। ধেয়ে আসছে বিশ্ব মন্দা। বিশ^ খাদ্য সংস্থার এমন বার্তার পর অনেকেই এখন আতংকিত। কারণ আগামী দিন গুলোতে যেহেতু সহজেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না  ফলে আতংক মনে বাসা বেঁধে মানসিক যন্ত্রনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বিশ্ব প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে দিনযাপন করছে যেখানে অনাহার এবং মৃত্যু প্রতিদিনকার বাস্তবতায় পরিনত হয়েছে। বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবরের ব্যবস্থা করার সামর্থ নেই। সেখানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, জলবায়ু সংকট, পরিবেশ বিপর্যয় এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও বেশি দুরবস্থার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জনসংখ্যার দেশে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির কষাঘাতে জর্জরিত প্রায় ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ। যা মোট জনসংখ্যার ৮৮%। এখানে সাধারণ মানুষ যেসকল খাতে অধিক পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার একটা জরিপ তুলে ধরা হয়েছে, যেমন- দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির কারনে ৮৮%, রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়বৃদ্ধির জন্য ৩৫%,  তেলের দাম পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য ৩০%, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২১%। সরকারিভাবে গৃহিত খাদ্য কর্মসূচির আওতায় রয়েছে ৫০ লাখ মানুষ। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ১৪ কোটি ৩ লাখ ৩৯ হাজার মানুষই খাদ্য কর্মসূচির বাহিরে রয়েছেন। জরিপে আরও বলা হয়েছে তিন বেলাই খাদ্য যোগাতে ব্যর্ত ১১ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। খাদ্য কিনতে ঋণ করতে হয়েছে ৬৪%, আর নিজস্ব জমানো সঞ্চয় ভাঙ্গতে হয়েছে ২৯% মানুষকে। মোটামুটি আর্থিক চাপের বাহিরে রয়েছে মাত্র ২ কোটি মানুষ।  

হিসেব যাই হোক না কেন নিম্ন বা মধ্য বিত্তের জন্য এখন থেকে একটু হিসেবী  না হলে যে হারে নিত্যপণের দাম বেড়েই চলেছে তাতে আপদ আসন্ন। আজ যেটার মূল্য আছে ১০০ টাকা কাল সেটা কতো হবে তা কারো জানা নেই। ফলে বাজারের উর্ধগতি নাগরিকের নাভিশ্বাস দিনের পর দিন  উর্ধাকাশে উঠে যাচ্ছে। দিনের পর দিন বাড়তে থাকলেও  কোনো নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কঠোর নজরদারী চোখে পড়ার মতো নয়।

বাজার করতে আসা রফিকুর ইসলামের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানা গেলো- সরকারি বেসরকারি ভাবে প্রতি বছর অর্থবছর শেষ হবার অথবা শুরু হবার কোনো একসময় চাকুরীর বেতন বৃদ্ধি পায় একবার সেটাও আবার ইনক্রিমেন্ট আকারে। মাঝারি কিংবা ছোট চাকুরিজীবির বেসিক অনুযায়ী কতইবা ইনক্রিমেন্ট বাড়ে। দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় অতি সমান্য বর্ধিত বেতনে আর সমন্বয় করা সম্ভব হয় না। 

আর দৈনন্দিন শ্রমিক কিংবা বেসরকারি বেশিরভাগ চাকুরীজীবির সন্তানদের লেখা পাড়ার খরচ আর দৈনন্দিন নিত্য চাহিদা পুরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে। রফিকুল ইসলাম আরও জানায়, প্রতি সপ্তাহে একদিন বাজার করলেও মাসিক বেতন দিয়ে হিসেবে করার পর পূর্বের জমানো কিছু টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে জামানো টাকা থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। জানিনা এমন অবস্থার অবসান কবে হবে, আদৌ হবে কি না। চাইলেই বেতন বৃদ্ধির কথা প্রতিষ্ঠানের মালিককে বলতে পারি না। কারণ বেতন বৃদ্ধির নিদ্দিষ্ট একটি সময় এবং অর্জন রয়েছে। কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারো কোনো অনুমতি লাগে না। যখন যা মন চায় তাই করা হয়। সাধারণ মানুষের আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ফলে হিসেব কষেও কাজ হচ্ছে না, ভোক্তার ভোগান্তি দিনের পর দিন চরম আকারে বেড়েই চলেছে। 

সময় উপযোগী বিবেচনা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরী। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা যদি বিশ্ব মন্দার কথা আচ করে থাকে। তবে বিচার বিশ্লেষণ করে সরকারকে এখনই কিছু বিষয়ে অধিক কঠোর হওয়া প্রয়োজন। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ, বীজ সারের যথাযথ সরবরাহ সহজীকরণ অথবা ভুর্তুকী প্রদান, অবৈধ মজুদদারি কিংবা দুর্নীতি নির্মুল করে সকলকে উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে টাকা রিজার্ভ রেখে মাঠ ফাঁকা রাখার কোনো মানে হয় না। টাকা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে প্রতিটি মানুষের দীর্ঘ মেয়াদী খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে সরকারকে সহযোগিতা করা একজন শিল্পপতি অথবা ধর্ণাঢ্য ব্যক্তির যথাযথ দায়িত্ব।

পাশাপাশি সরকারি ভাবে খাদ্য বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি, আবাদি জমি ফেলে না রাখার তাদিদে যথাযথ মনিটরিং বৃদ্ধি, বীজ সরবরাহ ও সহায়তা বৃদ্ধি ইত্যাদি সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা করতে না পারলে যতোই হিসেবই কষি না কেন বিপদ থেকে মুক্তি মিলবে না সহজেই। সমন্বয়ের পন্থা বাড়িয়ে দেশের সকল মানুষের ভোগান্তি নির্মুল করা এখন অন্যতম জরুরী বিষয় যা সর্বজন আলোচিত।  
লেখক ও উন্নয়ন কর্মী গাইবান্ধা। 
 

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad