• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১২-৮-২০২৩, সময়ঃ দুপুর ০২:২১
  • ১৫৪ বার দেখা হয়েছে

খাদ্য নিরাপত্তায় অনিরাপদ খাদ্য!

খাদ্য নিরাপত্তায় অনিরাপদ খাদ্য!

আশরাফুল আলম ►

সাধারণত যেসব আহার্য উপাদান জীবদেহের বৃদ্ধি, শক্তি উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ এবং ক্ষয়পুরণ করে তাকে খাদ্য বলে। মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষনা পত্রের ২৫/১ ধারায় প্রত্যেক মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে সেই খাদ্য অবশ্যই নিরাপদ এবং ভেজালমুক্ত হতে হবে। খাদ্যকে ভেজাল ও দুষণমুক্ত করে স্বাভাবিকভাবে বিতরণ নিশ্চিত করাই হচ্ছে খাদ্যের নিরাপদতা। নিরাপদ খাদ্যের অন্যতম শর্ত হচ্ছে পুষ্টিগুণ সঠিক রাখা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য প্রস্তুত ও সংরক্ষণে সকল ধরনের নিয়ম বা আইন মেনে চলা। 

প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোটামুটি সক্ষমতা অর্জন করলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে। সুতরাং স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাট, ফুটপাত, লঞ্চ স্টিমার, বাস স্ট্যান্ড, স্টেশন, হোটেল-রেস্তোরায় খাবার খেয়ে থাকি। মুখরোচক এইসব খাবারের মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে। কারণ, ভোক্তারা এসব খাবার খেয়ে নানাভাবে অসুস্থ ও স্বাস্থ্য-সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব খাদ্যসামগ্রীতে মেশানো হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রং ও রাসায়নিক উপাদান।

একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, রাস্তা বা ফুটপাতে যেসব খাবার তৈরি ও বিক্রি হয়, তার ৯০ শতাংশই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। রাস্তার পাশে খোলা স্থানে তৈরী করা এসব খাদ্যসামগ্রীতে দূষিত পানি ও ভোজ্যতেলের একাধিকবার ব্যবহার এবং পরিমানের চেয়ে বেশি রং অথবা রাসায়নিক উপাদান  ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ঝুঁকি। বাতাসে ধুলাবালি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন হাত ও পরিধেয় বস্ত্র থেকে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে খাদ্য অনিরাপদ হয়। অন্যদিকে শহর এবং গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত খামারে মাছ অথবা হাঁস-মুরগি কিংবা ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিষাক্ত বর্জের ব্যবহার অহরহ। কম মূল্যে এসব রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে খাদ্যের উৎসই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে নিরাপদ খাদ্য গ্রহনের বিকল্প নেই এটি জানার পরও একই সমাজে বাস করে জেনে বুঝেই শুধুমাত্র আর্থিক লোভের আশায় একে অপরকে মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছি।

অনিরাপদ খাদ্য গ্রহনের ফলে মানুষের শরীরে পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, বমি, জ্বর, আমাশয়, টাইফয়েডসহ নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়। ফলে একটি পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশ চিকিৎসার জন্য খরচ করতে হয় যেটি দরিদ্র্য, মধ্যবিত্ত অথবা যেকোনো পরিবারের জন্য কষ্টকর। ফলে সংসারের খরচের উপর চাপ বেড়ে যায়। একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, অনিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে প্রায় ২০০ রকম রোগ বিস্তার লাভ করে এবং দূষিত খাদ্য গ্রহণ করে বছরে প্রতি ১০ জনে ১ জন মানুষ অসুস্থ হয়। ফলশ্রুতিতে সারা বছর বিশ্বে প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। 

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের পদক্ষেপ খুব একটা দৃশ্যমান নয়। নাগরিক সচেতনতায় নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণীত হলেও বেশিরভাগ জনগণ এই আইন সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নয়। কারণ হিসেবে প্রচার প্রকাশণার ঘাটতির কথা জানা গেছে। বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায় কোন ভেজাল খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করা হয় সকাল দশটার পরে এবং বিকেল চারটার আগে। কিন্তু এই সময়ের আগে এবং সন্ধা কালীন সময়ে এসব দূষিত খাবার বিক্রি চলমান থাকে ব্যাপক হারে। দেখে মনে হয়, খাদ্য আইন আছে কিন্তু নিরাপদ খাদ্য নেই। সুতরাং মনিটরিং ব্যবস্থাপনাতেও সময়ের পরিবর্তন জরুরী।

খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মানহীন খাদ্য দ্রব্য তৈরী ও বিপণন করে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। আবার নিয়ন্ত্রীণহীন বাজারে অসহায় দরিদ্র্য মানুষ উপায়ন্তর না দেখে স্বল্প দামে মানহীন দ্রব্য ক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় পরে অকালে মৃত্যুর দিকে ঝুকছে। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাবারের বিভিন্ন রকম মুখরোচক বিজ্ঞাপনে মানুষকে আকৃষ্ট করে বিপণনে প্রতারণা অব্যহত থাকায় খাদ্য আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মিডিয়া প্রচার প্রচারনার ক্ষেত্রে খাদ্যের গুণগতমান বিবেচনা করে প্রচারের বিষয়টি সচেতন নাগরিকের দায়-দায়িত্বের মধ্যেই পরে।  

নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণীত হয় এবং ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিলো মুলতঃ- নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা, খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যকর নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা। নিরাপদ খাদ্য আইনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

যেমন- খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার সংক্রান্ত ধারা- ২৩ অনুযায়ী- মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা এর উপাদান বা বস্ত (যেমন-ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), বালাইনাশক (যেমন-ডিডিটি, পিসিবি, তৈল) খাদ্যের রং বা সুগন্ধি বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন বা প্রক্রিয়া সহায়ক দ্রব্য কোন খাদ্যদ্রব বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্ত করা অথবা অনুরুপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করার কারণে শাস্তি হিসেবে অনুর্ধ ৫ বছর এবং অনুর্ধ্ব ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধার রাখা হয়েছে।

ধারা-২৫ নম্বরে বলা হয়েছে, কোন ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন করা অথবা আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ বা বিক্রয় করার অপরাধে অনুর্ধ্ব ৩ বছর এবং অনধিক ৬ লক্ষ টাকা অথবা উভয় দণ্ডের শাস্তির বিধার রাখা হয়েছে। আবার নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে ২৬-ধারায় মানুষের আহার্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত মান অপেক্ষা নিম্নমানের কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ বিক্রয় করা অথবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ বা সরবরাহের অপরাধের শাস্তি হিসেবে অনুর্ধ্ব ৩ বছর এবং অনধিক ৬ লক্ষ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সর্বমোট ৯০টি ধারা সংবলিত এই আইনে একই রকমের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধার রাখা হয়েছে। ভোক্তা এবং বিক্রেতা উভয়েরই  খাদ্য আইন এবং এর শাস্তির ধরণ সম্পর্কে ধারনা থাকা জরুরী। কারণ, এক স্থানে যিনি বিক্রেতা অন্য স্থানে তিনিই ভোক্তা। ভোক্তা এবং বিক্রেতার বেশিরভাগই জানেন না নিরাপদ খাদ্য আইনে অপরাধের শাস্তি কি। সুতরাং ভোক্তা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্য আইনের শাস্তির ধারা সমুহ জানা অপরিহর্য্য।

দেশের সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অন্যতম একটি দায়িত্ব নিরাপদ খাদ্য  আইন ২০১৩ অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য প্রবিধানমালা ২০২০ কার্যকর করা। উক্ত প্রবিধানমালা খাদ্য ব্যবসায়ীদেরকে নানা বাধ্যবাধকতার আওতায় নিয়ে আসতে পারে। প্রবিধানমালায় খাদ্য ব্যবসায়ীদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য পণ্য ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার, খাদ্য তৈরীর জন্য কাঁচামালক্রয় ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এবং উৎপাদন কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। প্রবিধানের শর্ত পালন করতে ব্যর্থ হলে খাদ্য ব্যবসায়ীকে পড়তে হবে শাস্তির মুখে। 

দেশের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে স্বস্তির নিশ্বাস থাকলেও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে রয়েছে অস্বস্তি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা ও নিরাপদ খাদ্য আইন প্রয়োগ জরুরী। এক্ষেত্রে একজন সচেতন ভোক্তা হিসেবে আমাদের করণীয় যথাযথভাবে মানতে হবে। কোন ভুল ও মিথ্যা চাটুকর বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হওয়া থেকে সচেতন থাকতে হবে। একই সাথে খাদ্য সংরক্ষণ বা মজুদ করার সময় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সার্বিকভাবে আমাদেরকে খাবার ক্রয়কালীণ পছন্দের ওপর স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ খাদ্র গ্রহনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিকভাবে আমাদের সচেতনতার অংশ হিসেবে নিরাপদ খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মেনে চলা আমাদের জন্য আবশ্যিক।

যেমন- (১) খাবার প্রস্তুত ও গ্রহনের ক্ষেত্রে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। (২) খাদ্যবাহিত রোগ প্রতিরোধে কাঁচা ও রান্না করা খাদ্য আলাদা করে রাখা। (৩) সঠিক তাপমাত্রায় খাবার রান্না করতে হবে। খাদ্যের কেন্দ্রস্থ তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেঃ এ ন্যুনতম ২ মিনিট জাল করতে হবে। (৪) অনেক সময় পারিবারিক ভাবে খাবার ফ্রিজে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম মানা হয় না। তৈরীকৃত খাদ্য দ্রব্য ফ্রিজে নরমালে ৫ ডিগ্রি সেঃ এর নিচের এবং ডিপে দীর্ঘসময় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ১৮ ডিগ্রি সেঃ এর নিচের তাপমাত্রায় রাখতে হবে। (৫) নিরাপদ পানিদ্বারা শাক-সবজি ফলমুল পরিস্কার করে নিতে হবে।

সুতরাং খাদ্যের নিরাপদ সংরক্ষণ পারিবারিক সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, খাবারের উৎস থেকেই খাবার নিরাপদ রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আপনার আমার ঠিকানা হাসপাতাল নয়। আমাদের সকলের ঠিকানা হোক আপন ঘর।-লেখক-উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা, মোবাইল নম্বর-০১৭১৩৪৮৪৪১২।

নিউজটি শেয়ার করুন


এ জাতীয় আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়