আশরাফুল আলম ►
বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম। সমাজ নির্ধারিত সাধারণ জীবন যাত্রার মানের চেয়ে যাদের জীবন যাত্রার মান কম তারাই দরিদ্র এবং এই দরিদ্র অবস্থাকেই দারিদ্র্য বলে। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রদত্ত দারিদ্র্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী “দারিদ্র্য বলতে জীবনযাত্রার নূন্যতম মানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার হতে বঞ্জিত মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক অবস্থাকে বোঝায়।” দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সমস্যা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রভৃতি মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরনের অক্ষমতাই হচ্ছে দারিদ্র্য। একটি নূন্যতম পরিমান আয় উপার্জন ছাড়া এ সমস্ত অভাব পূরণ করা যায় না। তাই একটি নূন্যতম পরিমান আয় উপার্জনের অক্ষমতাকেই দারিদ্র্য বলা যেতে পারে।
দারিদ্র্য বিমোচনে পদক্ষেপ থাকার পরেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চরম দারিদ্র্য থেকে মানুষ কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে আসলেও অনেক মানুষ আবার দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে উঠে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, দারিদ্র্য নিরসনের পন্থা বা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সেখানে স্থায়ীত্বশীলতায় ঘাটতি রয়েছে। আমরা দেখি, দেশের দারিদ্র্য অঞ্চলে বসবাররত জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ জীবিকার তাগিদে ভালো আয় রোজগারের আশায় শহরে পারিজমায়। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্খিত জরুরি পরিস্থিতির কারণে কাজ কর্ম গুটিয়ে আবার তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অনিশ্চিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে। তখন দেখা যায় মানুষ তাদের জমানো অর্থ খরচ করে জীবিকায়ন করতে থাকে, এমনকি কেউ কেউ বেশি দিন বেকার থাকায় তাদেরকে ঋণ করে চলতে হয়।
শহরের পরিশ্রমের ধরনের সাথে গ্রামের কাজের পরিশ্রম এবং পারিশ্রমিক কোনটাই মিল থাকে না। ফলে দক্ষ হয়েও বাধ্য হয়েই পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত একটা বড় সময় তাদেরকে আয় রোজগার থেকে বিরত থাকতে হয়। শহরের তুলনায় গ্রামে কাজের বিস্ততি আকার ছোট। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকা বা বড় উদ্যোক্তা থাকার পরও অর্থলগ্নির প্রতি তাদের আগ্রহ কম। বড় বড় শহরের শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতার ফলে শহরের উপর জনসংখ্যার চাপও বেড়েই চলেছে। সেখানে অতি এবং সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন যাপনের ব্যয়ে অত্যাধিক চাপ বাড়ছে। তখন জীবন যাত্রার মান দারিদ্র্যতা হ্রাসে অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। স্থায়ীত্বশীল কর্মসংস্থান না থাকায় নাগরিকদের সঞ্চয়ের পূঁজি জামানোর সক্ষমতা একেবারেই দুর্বল।
তাছাড়া অনিশ্চয়তার কর্মক্ষেত্রে আসা যাওয়ার মধ্যে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণও কম নয়। দিনের পর দিন দ্রব্য মূল্য পরিস্থিতির সাথে প্রাপ্ত মজুরির পার্থক্যও বেড়েই চলেছে। মজুরি স্বল্পতায় যেকোনো অনাকাঙ্খিত ধাক্কা সামলানোর মতো সম্পদ দরিদ্র মানুষের হাতে নেই। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের যে অগ্রগতি তা বেশ দুর্বল বা ভঙ্গুর। যেমন সাম্প্রতিক সময়গুলোতে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো অনেক পরিবারের জন্য অসাধ্য হয়ে উঠেছে। এর ফলে অনেক পরিবার, দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
জাতিসংঘের দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত অলিভিয়ে ডি শ্যুটার বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠে আসার ধাক্কা সামলাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল পরিবর্তন করা উচিত। "রপ্তানি বাড়ানোর চাইতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর দিকেই বেশি নির্ভর করা উচিত’’। তার এই বক্তব্য থেকে এটাই প্রমাণিত যে, আমাদেও উন্নয়নের মডেল অনেক বেশি রপ্তানী এবং আমদানী নির্ভর। ফলে দেখা যায়, মাঝে মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের বিভিন্ন অস্থির পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রে দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং তখন উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এই মডেলে স্থায়ীত্বশীল উদ্যোগের কথা বলা হলেও সেই উদ্যোগের অর্জিত ফলাফল যেকোনো জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে উঠে আসলেও দীর্ঘসময় টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জিং হয়ে দেখা দেয়। আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশের তৈরী দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহারের প্রতি বেশি মনোযোগি হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া জরুরী একই সাথে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়ে খনিজ সম্পদ আহরণ এবং তৈরীকৃত পণ্য দ্রব্য ব্যবহারে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। চাহিদা ও সম্পদ ব্যবহার যত বেশি বাড়বে দেশের অর্থ বিদেশে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে এবং বিদেশী অর্থ আয়ের মাত্রাও বাড়বে। অন্যদিকে চাহিদা বাড়ার ফলে যেসকল নাগরিক দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি অবস্থান করে তাদের মজুরী নিশ্চিত থাকবে পাশাপাশি ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পুঁজির সুরক্ষা হবে। স্থায়ীত্বশীল দারিদ্র্যতা নিরসনের ক্ষেত্রে এধরনের ব্যবস্থা বড় ভুমিকা রাখতে পারে। তবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরনের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগকে অধিক উৎসাহিত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ দেয়া তথ্যানুযায়ী দেশে অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সত্বেও দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। নিদ্দিষ্ট ভাবে অন্তর্ভূক্তিতা এই হার কমতে থাকলেও বড় ধরনের ধাক্কা সামলাতে এই অগ্রগতি ধরে রাখতে উন্নয়ন মডেলে আরও বেশি স্থায়ীত্বশীলতা অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তার পরেও কোভিড পরবর্তীসময়ে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসের এই চিত্র আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। তবে এমন প্রত্যশা পুরনের পথে যেকোনো সময় যেকোনো অজানা দুর্যোগ পরিস্থিতি ব্যর্থ করে দিতে পারে সেই পরিকল্পনা। কারণ আমরা দেখেছি যে ২০১৯ সালের শেষের দিকে কোভিড-১৯ যেভাবে দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করেছে তা কারোরই জানা ছিলো না। এধরনের পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না, বিশ্বের অনেক নামি দামী দেশ হিমশিম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে। যার প্রভাব এখন পর্যন্ত বিদ্যমান।
এমন পরিস্থিতিকে কল্পনা করেই স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের মডেল বাস্তবায়নের উদ্যোগ তরান্বিত করতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। খাদ্যের নিরাপত্তার সাথে সাথে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা, খাদ্য উৎপাদনে গ্রামীণ পতিত জমির ব্যবহার বৃদ্ধি, দীর্ঘসময় সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, শহর ও গ্রামের তুলনামূলক দরিদ্র পরিবার শ্রেণী বিভাগ করে বিশেষ উদ্যোগে কর্মমূখী প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, শ্রমিকের সাময়িক মজুরি নিশ্চিত করনের সাথে সাথে স্থায়ীভাবে মজুরী প্রাপ্তীর নিশ্চয়তা, কারখানায় তৈরী পণ্য সহজে বাজারজাত করণ, সহজ শর্তে দীর্ঘ মেয়াদে মুলধন সরবরাহ, কৃষি ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা জোরদার করা, জলবায়ু প্রভাব জনিত দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গ্রাম ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান, মহিলাদেও আত্ব কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সারাবছরের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত করে মানুষকে শহরমুখী হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি।
দেশে দারিদ্র্যতার হার দিন দিন কমে আসছে এটি নিশ্চয়ই ভালো খবর কিন্তু এর সাথে সাথে চিন্তার বিষয় স্থায়ীত্বশীল আয় রোজগার বা মজুরির নিশ্চয়তা না থাকলে যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে আবার সেই হার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে অথবা অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। সুতরাং দারিদ্র্যতা হ্রাসের গতি এগিয়ে নিতে উন্নয়ন মডেলের বৈশিষ্ঠসমূহের গুনগত মান বৃদ্ধি এবং স্থায়ীত্বশীলতা বিবেচনা জরুরী। -লেখক- উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা।