মোহাম্মদ মারুফ আখ্তার►
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক। আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণার উৎস রংপুরের পীরগঞ্জের মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হন।
অসংখ্য পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে বুক উঁচু করে দুই হাত প্রশস্ত করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। তার প্রতিবাদের ভাষা ঠিকই বুঝে গিয়েছিলো সারা দেশের কোটি কোটি তরুণ, কিশোর, যুবক, যুবতী তথা আমজনতা। প্রতিবাদের দৃশ্য একটি গুলিবিদ্ধ হয়ে আবারও আবু সাঈদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং প্রতিবাদ করার দৃশ্য দেখে ফুঁসে উঠেছিলো পুরো দেশ।
দিনটি ছিলো ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। এ দৃশ্যের পর মনে হয়েছিলো বুলেট যেনো শুধু আবু সাঈদের দেহেই প্রবেশ করেনি, কোটি কোটি জনতার, আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বুকে বারুদ হয়ে প্রবেশ করে ভয়ংকররূপে বিস্ফোরিত হচ্ছিলো। আবু সাঈদের সেই না বলা কথা, নিঃশব্দ প্রতিবাদ যেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার চূড়ান্ত দামামা বাজিয়েছিলো, যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লজ্জ্বাজনকভাবে পতন ঘটে প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। পালিয়ে যেতে বাধ্য হন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা।
ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা থেকে আবু সাঈদ: ১৯৬৯-এর শহিদ বুদ্ধিজীবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ২০২৪ এ কিভাবে সাহস জোগালেন রংপুরের সন্তান আবু সাঈদকে। ফেসবুকে আবু সাঈদ, শামসুজ্জোহার সমাধিফলকে ছবি দিয়েছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনো গুলি তা ছাত্রকে না লেগে যেনো আমার গায়ে লাগে- শহিদ শামসুজ্জোহা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, শহিদ হওয়ার আগের দিন’। আবু সাঈদ লিখেছিলেন, ‘স্যার! এই মুহুর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিলো, সবাইতো মারা গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত’। ১৬ জুলাই ২০২৪ কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেন এবং শহিদ হন।
প্রসঙ্গত, উত্তর বাংলায় (দিনাজপুর-রংপুর) তেভাগা আন্দোলন ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস নেই। ২০২৪-এ এসে একজন আবু সাঈদ রংপুরকে সারা দেশ তথা বিশ্বের দরবারে গর্বের তিলক পড়িয়ে দিলো। একটি অনিন্দ্য সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন বিমানের ডানায় উড়িয়ে এনেছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর আর বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন আবু সাঈদ। বাংলাদেশের মানচিত্রের সামনে দু হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাহসিকতার প্রতীক আবু সাঈদ পাশে লেখা ‘বল বীর, চির উন্নত মম শীর’। দেখে মনে হয় আবু সাঈদের জন্যই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অমর লাইন রচনা করেছিলেন। শহরের পথে পথে বহু গ্রাফিতিতে লেখা আবু সাঈদকে সশ্রদ্ধ স্মরণ জানাতে তরুণ প্রজন্ম স্মরণ করছে কবির এই অবিস্মরণীয় কবিতা।
গৌরবের রংপুরে জন্ম নেওয়া নুরলদীন (ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন নুরলদীন) থেকে আবু সাঈদ পর্যন্ত এক একটি নাম অগ্নি শিখার অমিত তেজোদীপ্ত। ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ অধিকারের জন্য দাঁড়ানো স্লোগানটি জনগণের শক্তি, ঐক্য, ন্যায়, সাম্যের লড়াইয়ের শক্তিশালী অনুস্মারক। এই বিদ্রোহী স্লোগান রংপুরকে গৌরবান্বিত করে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছে। ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং প্রতিরোধের চেতনাকে ধারণ করে রংপুর অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আবার এই গৌরবের রংপুরে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া যিনি নারী জীবনকে দিয়েছিলেন পূর্ণ আলোকচ্ছটা। উনবিংশ শতাব্দির একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক এই নারী জেগে উঠেছিলো আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের ভূমিকা রেখে গেছেন। এই মহীয়সী নারীর পথ ধরেই নারীরা জেগে উঠেছে, আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে। নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নেই, সমাজের কোনো আশাও নেই- এই মূল মন্ত্রের বিশ্বাসী বেগম রোকেয়া সমাজে প্রবল প্রতাপের বাধা পেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার জাগরণে কাজ করে গেছেন রংপুরে জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী। নারী জাগরণের এই মহীয়সীর মৃত্যু হয় ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধ, প্রিয় কিংবা আনাস; এমন শত শত শিশু-কিশোর-তরুণের রক্ত বৃষ্টিতে স্নান করেছিলো বাংলাদেশ নামক জনপদে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাবন্ধিক, গাইবান্ধা।