কায়সার রহমান রোমেল, গাইবান্ধা►
কালের স্রোতে অনেক কিছুই বদলায়। যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট হচ্ছে, বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা। এই পরিবর্তনের ঢেউয়ে কোথাও যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে সম্পর্কের উষ্ণতা, ভালোবাসার বাঁধন। একসময়ের মমতাময়ী মা, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে আগলে রাখতেন গোটা সংসার, আজ হয়তো ঠাঁই পান বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গ প্রকোষ্ঠে। ঈদ, পূজা কিংবা কোনো উৎসবে দূর থেকে ভেসে আসা যান্ত্রিক কণ্ঠের ‘মা, কেমন আছো?’ প্রশ্ন যেন তাঁদের ক্লান্ত হৃদয়ে আরও গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়।
বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর মা দিবস পালিত হয়। উত্তরের জেলা গাইবান্ধাতেও গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে দিবসটি উপলক্ষ্যে থাকে নানা আয়োজন। এই বিশেষ দিনে সন্তানেরা তাদের মাকে নানাভাবে সম্মান জানায়, ভালোবাসা প্রকাশ করে। তবে, বৃদ্ধাশ্রমের প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন। সেখানে অনেক মা হয়ত তাদের সন্তানদের থেকে দূরে, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। এই মা দিবসে কেমন কাটে তাদের দিন? সেই চিত্র সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলাম গাইবান্ধার দুইটি বৃদ্ধাশ্রমে।
বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা বিষণ্নতা ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইট-কাঠের শুকনো কাঠামো, যেখানে আপনজনের স্নেহ বঞ্চিত কিছু বিষণ্নতা মুখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়ত সেই মায়েদের, যারা একসময় সংসার সামলেছেন, সন্তানদের মানুষ করেছেন, আর আজ বার্ধক্যে এসে নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ডুবে গেছেন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ছোট সোহাগী গ্রামে মেহেরুন্নেসা বৃদ্ধাশ্রমের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা জানালেন, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বৃদ্ধাশ্রমে বর্তমানে ৩২ জন আশ্রিত আছেন। এরমধ্যে ১৩ জন বাবা এবং ১৯ জন মা রয়েছেন। বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের একাকিত্ব¡ কোনো নতুন বিষয় নয়, তবে আধুনিক সমাজে এর ব্যাপকতা ক্রমশ বাড়ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রতি ঝোঁক, কর্মব্যস্ত জীবনে প্রবীণদের জন্য সময় বের করতে না পারা, কিংবা স্বার্থপর সন্তানদের অবহেলা- এমন নানা কারণে আজ অনেক মা তাদের শেষ আশ্রয় খুঁজে নেন কোনো বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে হয়ত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটে, মাথার উপর একটা ছাদ থাকে, দুবেলা খাবার জোটে। কিন্তু সেই সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের চেনা জগৎ, তাদের আপনজনদের সান্নিধ্য। যাদের কোলে মাথা রেখে সন্তানরা বড় হয়েছে, যাদের হাতের স্পর্শে শান্তি খুঁজে পেয়েছে, আজ সেই হাতগুলো নিঃসঙ্গ, অপেক্ষারত।
গাইবান্ধা জেলা শহরের সুখনগর এলাকায় ফিরোজা সালেক বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক শাহানা ইয়াসমীন লাকী জানান, ২৭ জন বাবা-মাকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালে তিনি এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এখানে ৪ জন বাবা এবং ১৬ জন মা আশ্রিত আছেন। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের দুবেলা খাবারসহ জীবনের অপরিহার্য্য প্রয়োজনগুলো মিটলেও, একাকিত্ব¡ তাদের কুরে কুরে খায়। দিনের পর দিন তারা তাকিয়ে থাকেন দরজার দিকে, হয়ত কোনো পরিচিত মুখ দেখতে পাবেন, হয়ত কোনো স্নেহের ডাক শুনতে পাবেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হয়, নীরবতায় ভেঙে যায়। শারীরিক কষ্টের চেয়েও এই মানসিক কষ্ট তাদের বেশি দুর্বল করে দেয়ে। তারা হয়ত তাদের ফেলে আসা দিনের গল্প বলতে চান, তাদের সন্তানদের কথা ভাগ করে নিতে চান, কিন্তু শোনার মতো কেউ থাকে না। বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালের মধ্যে তাদের জীবন যেন একটা বন্দিদশা, যেখানে স্মৃতিগুলোই একমাত্র সঙ্গী।
বাংলাদেশ নারী আন্দোলন গাইবান্ধা জেলা সভাপতি অধ্যাপক রোকেয়া খাতুন বলেন, বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের এই একাকিত্ব দূর করার দায়িত্ব শুধু সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই মায়েরা একসময় আমাদের সমাজের ভিত্তি ছিলেন। তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আজ যখন তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের পাশে থাকার, তখন তাদের একা ফেলে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জেলা সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ বলেন, সন্তানদের উচিত নিয়মিত তাদের মায়ের খোঁজ নেওয়া, তাদের সাথে সময় কাটানো। যদি একসাথে থাকা সম্ভব না হয়, অন্ততপক্ষে তাদের একাকিত্ব অনুভব করতে না দেওয়া। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের উচিত মাঝে মাঝে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করা, তাদের কথা শোনা। এছাড়াও, বৃদ্ধাশ্রমগুলোর পরিবেশ আরও মানবিক করে তোলা প্রয়োজন। সেখানে যেন মায়েরা একে অপরের সাথে মিশে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতে পারেন, সেই ধরনের সুযোগ তৈরি করা দরকার। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা বা অন্যান্য সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদের মনকে সজীব রাখা যেতে পারে।
চার ছেলে এবং দুই মেয়ে সন্তানের জননী বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা মালেকা বেগম জানান, মা দিবসের সকাল থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ থাকে অন্যদিনের চেয়ে একটু আলাদা। কিছু স্বেচ্ছাসেবী ও আশ্রমের কর্মীরা মিলেমিশে প্রাঙ্গণটিকে সাজিয়ে তোলেন। মায়েদের কারও চোখে-মুখে থাকে স্মিত হাসি, কারও দৃষ্টি হয়ত দূর দিগন্তে নিবদ্ধ- ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণে মগ্ন। হয়ত সেই স্মৃতি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের যৌবনে, তাদের মাতৃত্বের প্রথম দিনগুলিতে।
বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হাসেন আলী-নূরজাহান দম্পত্তি জানালেন, মা দিবসের দুপুরের খাবারের মেন্যুতে থাকে বিশেষ আয়োজন- পোলাও, মাংস ও মিষ্টি। মায়েরা একসাথে বসে পরম তৃপ্তির সাথে সেই খাবার খান। এই দিনটিতে কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি ও সংগঠন বৃদ্ধাশ্রমে এসে মায়েদের হাতে উপহার তুলে দেন। কেউ আনেন শাড়ি, কেউ ফল, আবার কেউ মিষ্টির প্যাকেট। উপহার পেয়ে মায়েরা যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও তাদের একাকিত্ব ভুলে যান, তাদের মুখে ফুটে ওঠে কৃতজ্ঞতার হাসি। তবে দিনের শেষে, যখন অতিথিরা চলে যান, তখন বৃদ্ধাশ্রমের নীরবতা যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন- মনে ভেসে ওঠে কোনও প্রিয় সন্তানের মুখ। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এই ভেবে যে, বিশেষ এই দিনেও তার পাশে তার সন্তানেরা নেই।
নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী বলেন, মা দিবস অবশ্যই প্রতিটি মায়ের জন্য আনন্দের দিন হওয়া উচিত। বৃদ্ধাশ্রমের এই মায়েরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের প্রতি আমাদের আরও সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। শুধু একটি দিন নয়, বছরজুড়ে তাদের খোঁজখবর রাখা, তাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো- এটাই হওয়া উচিত আমাদের কর্তব্য। আমরা সকলে মিলে বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের একাকিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের শেষ দিনগুলো একটু সুন্দর করে তোলার জন্য আমরা যেটুকু পারি, তাই করি। কারণ প্রতিটি মায়ের নিঃসঙ্গতা আমাদের সমাজেরই একটা নীরব কান্না।
বৃদ্ধাশ্রমের এই মায়েরা আমাদের সমাজের এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা হয়তো আমাদের ব্যস্ত জীবনে তাদের কথা ভুলে যাই, কিন্তু তারা আজও তাদের ভালোবাসার আঁচল পেতে বসে আছেন। তাদের প্রয়োজন শুধু একটু সঙ্গ, একটু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি।