কায়সার রহমান রোমেল►
চরাঞ্চলের ধূসর দিগন্ত, নদীর ভাঙাগড়া আর চরগ্রামের সংগ্রামী মানুষের জীবন- এই প্রেক্ষাপটে একজন আলোকচিত্রশিল্পী নীরবে কাজ করে চলেছেন। চর-দ্বীপচরের প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে তিনি কেবল ‘ছবিওয়ালা’, যাঁর ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ে তাঁদের যাপিত জীবনের চিত্র। আবার কেউ তাঁকে দেন আরও গভীর পরিচয়- ‘ছবির কবি’, যাঁর প্রতিটি ফ্রেমে কথা বলে মাটি ও মানুষের না বলা গল্প। এই দুই পরিচয়ের মিশেলেই তৈরি হয়েছে চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া এক ব্যতিক্রমী শিল্পীর জগৎ।
চরাঞ্চলের জীবন সহজ নয়। প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি আর অভাব-অনটনকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা এই জনপদের মানুষের। তাদের হাসি-কান্না, বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম হয়তো শহুরে কোলাহলের মাঝে হারিয়ে যায়। কিন্তু আলোকচিত্রী কুদ্দুস আলম তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে সেই প্রান্তিক জীবনকে তুলে ধরেন বিশ্ব দরবারে। তাঁর ছবিতে ঝলমল করে ওঠে নদীর ঢেউয়ের মতো বয়ে যাওয়া জীবন, শিশুদের নিষ্পাপ হাসি, ক্লান্ত জেলের জাল টানার মুহূর্ত কিংবা বন্যা-ভাঙনে বিধ্বস্ত ঘরের পাশে অসহায় মানুষের মুখ।
প্রান্তিক মানুষের কাছে তিনি কেবল একজন ‘ছবিওয়ালা’, কারণ তাঁরা দেখেন শিল্পী তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের ছবি তোলেন। হয়তো কোনো উৎসব-পার্বণে, হয়তো কোনো বিপদে-আপদে তিনি ক্যামেরা নিয়ে হাজির হন। স্থানীয় হাট-বাজারে, নদীর ঘাটে কিংবা বিদ্যালয়ের আঙিনায় তাঁকে দেখা যায় ছবি তুলতে। সেই ছবি হয়তো কারো স্মৃতি হয়ে থাকে, কারো কাছে আবার সামান্য কাগজের টুকরো। কিন্তু এই ‘ছবিওয়ালা’র লেন্স ভেদ করে যে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, তা কালের সাক্ষী হয়ে থাকে।
আবার কেউ তাঁকে ‘ছবির কবি’ আখ্যা দেন। কারণ তাঁর তোলা প্রতিটি ছবি যেন এক একটি কবিতা। সেই কবিতায় থাকে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনগাথা, প্রকৃতির নীরব বার্তা, হারানোর বেদনা আর নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। তাঁর ফ্রেমে ধরা দেয় বর্ষার কাদা মাখা পথে শিশুদের দুরন্তপনা, শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে মোড়া জাল-জল আর নৌকার সাথে নদীজীবী মানুষ কিংবা গোধূলিবেলায় ক্লান্ত পাখির নীড়ে ফেরা। এই ছবিগুলো কেবল ছবি নয়, এ যেন এক একটি অনুভূতি, যা দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
আলোকচিত্রশিল্পী কুদ্দুস আলমের কাজের ধরণও বেশ আলাদা। তিনি কোনো আরোপিত দৃশ্য তৈরি করেন না বরং মিশে যান সাধারণ মানুষের সাথে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। ফলে তাঁর ছবিতে যে স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতা থাকে, তা সহজেই দর্শককে আকৃষ্ট করে। তিনি জানেন, চরাঞ্চলের মানুষের গল্প বলার জন্য কোনো কৃত্রিমতার প্রয়োজন নেই। তাদের জীবনই এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে প্রতিনিয়ত আঁকা হচ্ছে নতুন নতুন ছবি।
এই ‘ছবিওয়ালা’ বা ‘ছবির কবি’ হয়তো কোনো বড় শহরে খ্যাতি লাভ করেননি, হয়তো তাঁর কাজ কোনো নামিদামি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়নি। কিন্তু চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে তিনি এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। কারণ তিনি তাদের জীবনকে মর্যাদা দেন, তাদের গল্পকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর ক্যামেরা যেন তাদের কণ্ঠস্বর, যা নীরব প্রান্তরের মানুষের কথা বলে।
কুদ্দুস আলম আসলে কেবল ছবি তোলেন না, তিনি রচনা করেন এক দৃশ্যকাব্য। তাঁর প্রতিটি ফ্রেমে লুকিয়ে থাকে চর-দ্বীপচরের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি আর প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। তিনি হয়তো ‘ছবিওয়ালা’ হিসেবে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজের গভীরতা ও আন্তরিকতা তাঁকে ‘ছবির কবি’র আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর এই দুই পরিচয়ের মাধ্যমেই তিনি হয়ে উঠেছেন চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের কাছের একজন শিল্পী, যাঁর তোলা ছবি কালের সাক্ষী হয়ে বয়ে বেড়াবে তাদের জীবনকথা।
হ্যাঁ, আলোকচিত্রশিল্পী কুদ্দুস আলম সত্যিই তার ক্যামেরার লেন্সে কবিতার মতো ছবি আঁকেন। তার কাজের মধ্যে একটি নান্দনিক এবং কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। তিনি এমনভাবে দৃশ্য ধারণ করেন যা কেবল বাস্তবতার প্রতিচ্ছবিই নয় বরং দর্শকের মনে গভীর আবেগ এবং অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কুদ্দুস আলমের ছবিতে প্রায়শই প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানুষের জীবনযাত্রা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট এমনভাবে উঠে আসে যা একটি গল্পের মতো মনে হয়। তার প্রতিটি ছবিতে আলোর খেলা এবং বিষয়ের নির্বাচন অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং শৈল্পিক। এই কারণেই তার তোলা ছবিগুলি কেবল ছবি নয় বরং এক একটি কবিতা বা চিত্রকর্মের মতো। আলোকচিত্রশিল্পী কুদ্দুস আলম তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি এবং শৈল্পিক দক্ষতার মাধ্যমে ক্যামেরার লেন্সে সত্যিই কবিতার মতো ছবি সৃষ্টি করেন।
আলো আর ছায়ার মায়াবী খেলা, মুহূর্তদের ফ্রেম বন্দি করে রাখা আলোকচিত্রশিল্পী কুদ্দুস আলম যেন সময়ের পাহারাদার, যিনি তার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে জীবনের না বলা গল্পগুলোকে ভাষা দেন। একটি বিষণ্ন মুখের ক্লোজ-আপ, দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের ছবি কিংবা শিশুদের হাসিমাখা মুখ- এইসব ছবি যেন এক একটি স্বতন্ত্র কবিতা, যা আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়। তাঁর কাজ শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, যা আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে অনুপ্রাণিত করে।
আমার জীবনে এমন কিছু মানুষ এসেছেন যাঁদের সান্নিধ্যে আমি ঋদ্ধ হয়েছি। তাঁদের মধ্যে একজন কুদ্দুস আলম, শুধু আমার চেয়ে বয়সে বড় নন বরং তিনি আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু এবং কর্মক্ষেত্রে অপরিহার্য সহকর্মী। প্রথম যখন তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়, তখন তাঁর ব্যক্তিত্বের স্থিরতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শুধু পেশাগত দিক থেকেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি। অসম বয়সের আমাদের একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই অগ্রজের সান্নিধ্য আমার জীবনকে অনেক বেশি সহজ ও সুন্দর করেছে। আমার অগ্রজ প্রিয় বন্ধু-সহকর্মী কুদ্দুস আলম সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী