আশরাফুল আলম►
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে শত শত নদী। আর এই নদীর বুকচিরে জেগে উঠেছে হাজারো বালুচর। প্রত্যেকটি চরের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র রূপ। মানুষ, সমাজ সংস্কৃতি এবং প্রতিকুল পরিবেশ সব মিলেই চরের ভৌগোলিক অবস্থা অন্য রকম। এক কথায় চরের জীবন সাধারণ জীবনের বাইরে অন্য এক জগত। কথায় বলে ‘চরের জীবন পরের জীবন’। অর্থাৎ জীবনের বেশিরভাগ সময়ই অন্যের উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় চরের মানুষের জীবন ও জীবিকা।
ভূতত্ত্ববিদগনের মতে, প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের কারণে সমতল ভুমি ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ভাঙনের ফলে পানির সাথে প্রবাহিত বালি-কাদার সিংহভাগ নদ-নদীর বুকে ক্রমেই উঁচু হয়ে ওঠে, আর এই উঁচু হয়ে উঠা ভুমিকে বলা হয় চর। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় চরাঞ্চলের জমির পরিমাণ ০.৮৩ মিলিয়ন হেক্টর, তার মধ্যে প্রায় ০.৫২-০.৭৯ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ যোগ্য।
গাইবান্ধা উত্তরের জেলা গুলোর মধ্যে পিছিয়ে থাকা অন্যতম একটি জেলা। পূর্বের তুলনায় কিছুটা পরির্তন হলেও এখনও এই জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান অন্যান্য জেলার তুলনায় পিছিয়ে। ব্রম্মপুত্র, তিস্তা এবং যমুনা নদী এই অঞ্চলের বৃহৎ নদী। ব্রম্মপুত্র এবং যমুনা নদীর প্রশস্ত এতো বেশি যে নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠে নদী পারের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করেছে।
জেলার ৪টি উপজেলায় (সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ এবং গাইবান্ধা সদর) প্রায় ১৬৫টি ছোট বড় চরের অবস্থান। সবগুলো চরের জীবন যাত্রার প্রকৃতি প্রায় একই রকমের। গত তিন দশকে কিছুটা পরিবর্তন হলেও এখনও মানুষের জীবন ও জীবিকা যথাযথ মান উন্নয়নের মুল স্রোতধারা থেকে অনেক পিছিয়ে। চরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ,পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অনগ্রসরতা এবং রাজনৈতিক বিভেদ দ্রুত উন্নয়নের পথে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও চর ও নদী পারের এবং সমতল ভুমির মানুষের জীবিকায়নে এখনও যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এমন অবস্থার জন্য প্রাকৃতিক অবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনে সীমাবদ্ধতা। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ এবং গাইবান্ধা সদর উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ছোট বড় প্রায় ১৬৫টি চর রয়েছে। এই চরগুলোর সাথে সমতল ভুমির যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা চরের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এইসব চরের মানুষের বড় একটি সংখ্যা পূর্ণ নাগরিক সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। অনেক স্থানেই সেবা প্রতিষ্ঠান/বিভাগ তাদের কাছে পৌঁছেতে পারেনি।
আবার কোথাও কোথাও সেবা প্রতিষ্ঠান পৌঁছেতে পারলেও নাগরিক সচেতনতার অভাবে উন্নয়নের গতি ধীরে চলছে। নদী ভাঙনে হাজারো গ্রাম বিলীন হওয়ায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে চরের সামাজিক বন্ধন। প্রতিবছর সমতল এবং জেগে উঠা উর্বর মাটি সমৃদ্ধ চরসমূহ একের পর এক ভেঙে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে তেমন গতি পাচ্ছে না এবং বছরের কিছু সময়ে খাদ্য ঘাটতি লক্ষনীয়।
শিশু শিক্ষার অগ্রগতি সমতল ভুমিতে যে গতিতে এগিয়ে চলছে একই সিলেবাস ভুক্ত হয়েও চরের শিশুরা সেই গতি থেকে পিছিয়ে। কারণ হিসেবে দেখা যায়, চরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত বেশিরভাগ শিক্ষকদের বাড়ী সমতল ভুমি এবং শহর এলাকায়।
বিদ্যালয় শিক্ষকের অনুপস্থিত, নদী ভাঙ্গন এবং বর্ষার সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, চর ভাঙ্গনে শিক্ষার্থীর পরিবার অন্যত্র স্থানন্তর, শিশু শ্রম, উপযুক্ত পরিবেশ ও উপকরণ ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে শিশুর শিক্ষা যথেষ্ট পিছিয়ে। অন্যদিকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা পার হতে না হতেই বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে।
মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ না থাকা, কমবয়সেই শারীরিক পরিবর্তন এবং পারিবারিক অভাবের তাড়নায় বাবা মা একরকম বাধ্য হয়েই অপরিনত বয়সেই বিয়ে দিয়ে থাকেন। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে একঝাঁক শিশু শিক্ষার্থীকে পিছনে ফেলে অর্জন কতটা সম্ভব তা নিশ্চয়ই আমরা বুঝি।
চরের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার কথা খুব আশানুরুপ নয়। আধুনিক সেবার সুযোগ সমৃদ্ধ সময়ে চরের একজন গর্ভবতী নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা দেয়ার মতো ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। জীবন মৃত্যুর মধ্যিখানে কাঠের জলচৌকিতে রশি বেঁধে লাঠি দিয়ে কাঁধে করে নিয়ে দীর্ঘ মরুপথ পারি দিয়ে পৌছাতে হয় স্বাস্থ্য ক্লিনিকে।
উদাহরণ হিসেবে অন্তঃসত্ত্বা নারী হেলেনা বেগমের কথা দেশবাসী প্রায় অনেকরই জানা। ফুলছড়ি উপজেলার দুর্গম চরে তার বাড়ি। বাড়ি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় ২৫ কিঃ মিঃ দুরে। তৃতীয় সন্তান প্রসব বেদনায় যখন ছটফট করছিলো তখন হাতের কাছে কোন চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় ঘোড়ার গাড়ি আর কাঠের জলচৌকিতে নিয়ে ২৫ কিঃ মিঃ মরুপথ পাড়ি দিয়েও অবশেষে সন্তানসহ প্রাণ যায় হেলেনা’র। তবে শুধু হেলেনা বেগমের কথাই নয়, যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ অসুস্থতায় সকল মানুষের বেলাতেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ হলেও এখনও চরের অসহায় মানুষগুলো বহুলাংশে পুষ্টিহীনতার শিকার। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসলেও তা সমতল ভুমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরজন্য কিছুটা প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা এবং চরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দায়ী। এখানে মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি হওয়ায় গুনগতমান দুর্বল, সেচ ব্যবস্থার স্বল্পতা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকা, গুণগতমান সম্পন্ন বীজ না পাওয়া, কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যয় বহুলতা ইত্যাদি কারণে যথাযথ সফলতায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া প্রতি বছর বন্যা এবং খরায় ফসলের ক্ষতির ফলে পরিবারের পুরুষ সদস্য আয় রোজগারের জন্য জেলার বাহিরে থাকায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে অর্থাভাবেই কোন কোন সময় না খেয়েই দিন পার করতে হয়। এমন অবস্থায় সরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা হিসেবে নিরাপদ আশ্রয় পাবার অধিকার রয়েছে। তবে একাধিকবার নদী ভাঙনের শিকার এই মানুষ গুলোর প্রত্যাশা খুবই কম। ইচ্ছে হলেও ঘর তৈরির উপকরণ পরিবহন আর মিস্ত্রির মজুরীর কারণে দালান কোঠা ঘর নির্মাণের কথা ভাবাই দুঃসাধ্য।
নদী ভাঙ্গন এবং বন্যার আশংকায় তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে বসতভিটা তৈরিতে প্রতিবছর অনেক অর্থ খরচ হওয়ায় তাদের অর্থ সঞ্চয়ের সুযোগও কম। অসহায় দরিদ্র মানুষকে তালিকা ভুক্ত করে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হলেও চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা চরের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ। নদীর বিশাল জলরাশির বিভাজন শুধু শহর আর চরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করেনি, যাবতীয় উন্নয়নের সুফল থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে। গাইবান্ধা জেলার চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত বর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়ে করলেও শুকনো মৌসুমে পায়ে হাটা, গরু/ঘোড়ার গাড়ী/ব্যক্তিগত মোটর সাইকেল যা শুধু গুটি কয়েক পরিবারের সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে। বালু পথে পায়ে হেঁটে প্রায় ৫/৭ কিঃ মিঃ পারি দিয়ে সমতল ভুমিতে হাট-বাজার এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শুধু মানুষ নয় সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনের সুযোগ না থাকায় মাথা এবং কাঁধে নিয়ে পরিবহন করতে হয়।
এছাড়াও চরের মানুষের জীবন ও জীবিকায়নে আরও কিছু চ্যালেঞ্জিং বিষয় রয়েছে, যেমন- উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বল্পতা, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সরবরাহ নেই, চাহিদা মোতাবেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবা উপকরণ সরবরাহ কমতি, উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা না থাকা, প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি, নিকটে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি, ব্যাংক ঋণ সহায়তার সুযোগ না থাকা, পণ্য স্টোরেজ ব্যবস্থা না থাকা, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, সূপেয় পানির স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় বিনোদন ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি।
চরের মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ গৃহপালিত প্রাণী। বলা যায় প্রাণী সম্পদ চরের মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম উৎস। উপযুক্ত পরিবেশ আর পর্যাপ্ত প্রাণী খাদ্য থাকায় চরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কম বেশি গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগী, কবুতরসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী সম্পদ পালন করে থাকে। চরে মাটির প্রকৃতি অনুয়ায়ী কৃষি উৎপাদনে অনানুষ্ঠানিকভাবে নতুন নতুন উদ্ভাবনীতে চরের মানুষ অভ্যস্ত। তবে তাদের সীমিত জ্ঞান ও দক্ষতা তাদের বিভিন্ন উদ্ভাবনীকে থমকে দেয়।
এক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চরের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সরকারি বেসরকারিভাবে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করলে পণ্য সহজেই ক্রয় বিক্রয় হবে। জেলার ব্রন্ডিং শ্লোগানের অংশ হিসেবে চরাঞ্চলের ভুট্টা মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ। বর্তমানে এইসব চরের মাটি ভুট্টা ও মরিচ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সবজি, কাউন, গম, চিনাবাদামসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয়।
চরের নারীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। তাদের শ্রমকে সম্পদে পরিনত করতে পারলে সকলের জন্য মঙ্গল। আমার গ্রাম আমার শহর শ্লোগানের বাস্তবায়নের সাথে আরও একটি বাক্যকে আমরা আমাদের চর্চায় নিতে পারি। আমার গ্রাম হোক আমার আয়ের উৎস। চর এলাকায় প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদন হয়। এই দুধ সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারায় অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হন। সুতরাং যদি বিভিন্ন চরে দুধ সংরক্ষণাগার স্থাপন করা সম্ভব হয় তবে কৃষকের ক্ষতি কমিয়ে মানুষের পুষ্টি চাহিদাও পুরণ করা সম্ভব হবে।
ভৌগোলিকভাবেই চরের মানুষের স্বপ্ন হাজারো প্রতিকুলতার আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা। বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি, কুসংস্কার, বিধি নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। এমন পরিস্থিতির সাথে প্িরতনিয়ত লড়াই করেই চরের মানুষ তাদের জীবন পরিচালনা করে যাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে আধুনিক সেবার মান নিয়ে আধুনিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে এগিয়ে নিতে হবে এই সকল পিছিয়ে পড়া মানুষদের।
এসডিজি’র অভীষ্ট্য অর্জন কাউকে পেছনে ফেলে সম্ভব নয়। তাই চরের যথাযথ সমস্যা চিহ্নিত করে উপযুক্ত অর্ন্তভূক্তিমূলক সমাধানের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে এসডিজি’র লক্ষমাত্রা। আর এই অর্জনের মাধ্যমে চরেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে স্মার্ট ইকোনোমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট সিটিজেন এবং স্মার্ট গভারমেন্ট। আর তখনই চরের জীবন আর পরের জীবন থাকবে না। সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে উন্নয়ন সমৃদ্ধ স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা।