Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২৫-১২-২০২৩, সময়ঃ সন্ধ্যা ০৬:৪০

জাতিসংঘের উদ্যোগ গুরুত্বহীন ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার উপেক্ষিত

জাতিসংঘের উদ্যোগ গুরুত্বহীন ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার উপেক্ষিত

আশরাফুল আলম

খ্রিস্টানদের উৎসবমূখর বড় দিনে মুসলমানদের উপর ইহুদী ইসরাইল সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ থেমে নেই। টানা ৭৯ দিন ধরে গাজায় মুসলমানদের তাজা প্রাণ এভাবেই কেড়ে নিচ্ছে তারা।এপর্যন্ত ২০,৪০০ জনের উপরে ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত। কোন আশ্রয় কেন্দ্রই এখন আর নিরাপদ নয়। কারণ ইসরাইল ইহুদী সেনারা নিরীহ, নিরস্ত্র বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলে সেখানেও বিমান হামলা এবং গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এধরনের আগ্রাসন কর্মকান্ড অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ। জাতিসংঘের কোন উদ্যোগই যেন গুরুত্বপাচ্ছেনা ইসরাইলের নিকট। ফলে বিশ্ব শান্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের ক্ষমতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

স্বাধীনতা একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্রের বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার প্রতীক। যেখানে একটি জাতির নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব থাকবে। কিন্তু স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা সাথে বর্বরতা এবং অমানবিকতা।সভ্যতা গতিশীল হওয়ার পর থেকে পৃথিবী কখনো শান্ত ছিল না। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ, দখল আর ক্ষমতার পালাবদলের বহু ইতিহাস কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণ গেছে। নদীর জল মানুষের রক্তে লাল হয়েছে; কিন্তু রক্ত নিয়ে খেলার ইতিহাস পরিবর্তন হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ গঠিত হয়। 

জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়ন, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায় দূরীকরণে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘ। কিন্তু একাধিক যুদ্ধ থামাতেকিংবা মীমাংসা করতে বর্তমানে জাতিসংঘের ভুমিকা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নিকট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সংঘের প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মতবিরোধ যেন প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে।

বহু সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতেজাতিসংঘ উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে এখন পর্যন্ত ব্যার্থ। জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল মূলত বিশ্বের শান্তি রক্ষা করার পাশাপাশি বিশ্বকে নিরাপদ করে গড়ে তোলা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেদেশগুলোকে সহায়তা করা। জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন- এর মতানৈক্যে ফাটল এবং অস্ত্র ও বাজার প্রতিযোগিতায় আগ্রাসী আচরনের কারণে জাতিসংঘের যেকোনো উদ্যোগ তাদের নিকট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। 

মানবিকতার বিবেচনা না করে বড় বড় রাষ্ট্রসমূহ অসম প্রতিযোগিতায় নেমে মুল লক্ষ্য থেকে সড়ে এসেছে। এখানে মানুষের ক্ষুধা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং নিরাপত্তার কোন চিন্তা এখন তাদের মাথায় নেই অথবা থাকলেও আগ্রাসনের কাছে সেই বিবেক পরাজিত। এখানে ক্ষমতার দ্বন্দই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আজ সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চুড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে। কারণ অস্ত্র প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্যই হলো স্থল, আকাশ ও নৌপথে নিজের দেশকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখা। 

আদিকাল থেকে ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ড বা এর কোনো কোনো অংশ বিভিন্ন রকমের জাতিগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত ও শাসিত হয়ে আসছে। ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। যেখানে বর্তমানে পাশাপাশি অবস্থানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীরা বসবাস করছে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডটি ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে রয়েছে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস যা অনেক লম্বা।

বর্তমান সময়ে বিশ্বে অন্যতম জটিল ইস্যু ইসরাইল ও ফিলিস্তিন যুদ্ধ। দীর্ঘদিনের অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনের প্রতিবাদ আর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত স্বাধীনতাকামী হামাস গোষ্ঠীর আকস্মিক আক্রমনের পর শুরু হয় স্মরণকালের ভয়াবহ যুদ্ধ। কিন্তু দুই পক্ষের যুদ্ধ খুব কম সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের সকল নিয়মনীতি ভুলন্ঠিত করে হত্যা যজ্ঞে রুপ নিয়েছে। বিশেষ করে ইসরাইল সেনারা যে ধরনের আগ্রাসন চালাচ্ছে তা রীতিমত যুদ্ধাপরাধ মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করেও কোন ফয়দা হচ্ছে না। 

এমন একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের কথার তোয়াক্কা না করেই অনবরত বর্বরতা চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে তারা। মুসলমান হত্যাই যেন তাদের লক্ষবস্তুতে পরিনত হয়েছে। ফিলিস্তিন জনগণকে তারা পাখির মতো হত্যা করছে। যেকোনো নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা মানুষ গুলো কোন কিছু  বুঝে ওঠার আগেই বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ছে দেহের অংশ। ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল, খাদ্য, পানি, ঔষধ, বয়স্ক, শিশু, অসুস্থ, গর্ভবতী ও প্রসুতি নারীসহ সকল কিছুর উপরে চলছে বর্বরতা এবং অমানবিক আচরণ। তাদের ইচ্ছাই যেন এই গাজা উপতক্যায় প্রাণের অস্তিত্বকে নির্মূল করা। 

বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী যুদ্ধের ৭৯তম দিন পর্যন্ত গাজায় ফিলিস্তিনিদের নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ৪২৪ জন, যাদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু। একই সময়ে আহতের সংখ্যা প্রায় ৫৩,৫০০ জনের উপরে।আর নিখোজ ব্যক্তির সংখ্যা জানা গেছে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ জন। এছাড়াও হাজার হাজার পরিবার ঘরবাড়ি সহায়-সম্বল হারিয়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। 

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবী আদায়ের জন্য মায়ের কোলে থাকা শিশুর প্রাণ যাচ্ছে বোমার আঘাতে, বাবার হাত ধরে পথে থাকা শিশুও মরছে একইভাবে। অনেক আদরের ছোট্ট শিশুর ছোট্ট শরীরটি কাপড়ে মুড়ে মা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে দাফন করতে। কিন্তু এই কলিজার টুকরা শিশু সন্তান দাফন করতে গিয়ে বাবাকেও কাফনের কাপড় পরতে হচ্ছে। হাসপাতালে শিশুদের আহাজারী, আর বুকফাঁটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। অনেকেই হয়তো জানে না তাদের পিতামাতা আর বেঁচে আছে কি-না। আবার কেউ বুকফাঁটা আর্তনাদ নিয়ে বাবার লাশের পিছনে ছুটছে। তথ্য প্রযুক্তির কৃক্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘হাবসোরা’  ব্যবহার করে গাজায়প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। গাজার বাসিন্দাদের জন্য আর কোনো স্থানই যেন নিরাপদ নয়।

গাজায় ফিলিস্থিনিদের উপর রকেট এবং বোমা হামলা মানবাধিকারের চরম লংঘনের সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে চলেছে ইসরাইল সেনা সদস্য। পশ্চিমা নেতারা সবকিছুই দেখছেন। তাঁরা দেখছেন যে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষদের (যাদের অর্ধেকই শিশু) অভুক্ত রাখা হচ্ছে, তাদের পানি পান করতে দেওয়া হচ্ছে না, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বর্তমানে কোন হাসপাতাল অথবা চিকিৎসা সেবার কোন প্রতিষ্ঠান সচল নেই। সব হারিয়ে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে গাজার বাসিন্দারা। এমন অবস্থা একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এখন পর্যন্ত পশ্চিমা মোড়ল রাষ্ট্রসমূহ ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধে কিছুই করেননি। উল্টো তাঁরা ইসরাইলকে অনবরতভাবে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পুরস্কৃত করছেন। 

যেকোনো জাতি গোষ্ঠী তাদের ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করেই স্বাধীন থাকার অধিকার রয়েছে। স্বাধীন ও সুন্দর জীবন যাপন প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনা পত্রের ১-৩ ধারায় যেকোনো জাতি গোষ্ঠীর বা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করণের কথা বলা হয়েছে। যেমন- এই ঘোষণাসকল জাতি এবং রাষ্ট্রের সাফল্যের সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে সেই লক্ষ্যে নিবেদিত হবে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গ এ ঘোষণাকে সবসময় মনে রেখে তাদের আচরণ সংযত করবে। আরও বলা হয়েছে সকল সদস্য রাষ্ট্র ও তাদের অধীনস্থ ভূখণ্ডের জাতিসমূহ উত্তরোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়াসের মাধ্যমে এই অধিকার এবং স্বাধীনতাসমূহের সার্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি আদায় এবং যথাযথ পালন নিশ্চিত করবে।

কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে যদি স্বাধীন স্বীকৃতি না দেয়া হয় তবে সেখানে মানুষ থাকলেও তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে কিভাবে? যাই হোক দীর্ঘদিন থেকে ফিলিস্তিনিরা স্ব-ঘোষিত স্বাধীনতাকামী জনগন। তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সকল ধরনের অধিকার নিশ্চিত ও তাদের জীবনের সুরক্ষার দায়িত্ব জাতিসংঘের। জাতিসংঘ যদি মানবাধিকারের সনদ ঘোষনা করে তবে পৃথিবীর সকল নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে এবং সেটা অত্যন্ত জরুরী আর প্রভাশালী সদস্য রাষ্ট্রসমূহের তা অনুধাবন করা উচিৎ। 

সার্বজনীন ঘোষনা পত্রের ধারা-১ এ সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিৎ বলে জাতিসংঘ মনে করে। ঘোষণায় আরও উল্লেখিত যে,স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে। যদি তাই হয় তবে ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি বা সীমানা নিয়ে ইসরাইলের এতো আপত্তি কেন। ধারা-৩ এ বলা হয়েছে জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে। সুতরাং ইসরাইলের অযৌক্তিক আগ্রাসন গ্রহণযোগ্য নয়। 

 

লেখক : উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা।

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad