• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২০-৯-২০২৩, সময়ঃ সকাল ১০:৩২
  • ১১৮ বার দেখা হয়েছে

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতির অশুভ আচরণ

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতির অশুভ আচরণ

আশরাফুল আলম►

প্রকৃতি ও পরিবেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকায় সৃষ্টি হয় উত্থান ও পতন। পরমকরুনাময়ের অপরুপ সুন্দর পৃথিবীকে নানা ধরনের গাছপালা, তরুলতা আর বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি সৃষ্টি করে পৃথিবীকে সুসজ্জিত করেছেন। কিন্তু মানুষের বিরুপ আচরনে সেই সুন্দর পৃথিবীও আজ প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।পৃথিবী বিভিন্ন দুর্যোগের মাধ্যমে মাঝে মধ্যে গর্জে উঠে ধব্বংস করে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে অন্যতম আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন ও তার রিরুপ প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি।  আগামীর পৃথিবী গড়তে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব।

বিভিন্ন আলোচনার বিষয় থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন হলো কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার ২৫-৩০ বছরের বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার অর্থপূর্ণ পরিবর্তন। আমরা জানি, প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন পৃথিবীতে যে সূর্যকিরণ পৌঁছায় ভ‚-পৃষ্ঠ তা শোষণ করে। শোষিত সূর্যকিরণ আবার মহাশূন্যে বিকিরিত বা প্রতিফলিত হয়। প্রকৃতির এই শোষণ ও বিকিরণের নিয়মে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর জলবায়ু অতীতেও পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও পরিবর্তিত হবে বলে জলবায়ু বিজ্ঞানীগণ আশঙ্কা করছেন।

মূলত মানুষের সৃষ্ট অপরিকল্পিত প্রক্রিয়ার ফলেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ পরিলক্ষিত, তবে প্রাকৃতিক কারণেও স্বাভাবিকভাবে জলবায়ুতে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমনঃ পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক-পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদি কারণও বিদ্যমান।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর মানুষসৃষ্ট কলকারখানা ও যানবাহনে তেল ও গ্যাস ব্যবহার, বিলাসবহুল জীবন যাপনে গরমে ঘর ও গাড়ী শীতল রাখতে অতিরিক্ত  এসি ব্যবহার, কয়লা পোড়ানো, বিভিন্ন স্থানে গাছ নিধন ও গাছ পোড়ানো ইত্যাদি কর্মকান্ডের ফলে পূর্বের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমন্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে, সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমন্ডলে নিঃসরিত হয়। সুতরাং গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিও জলবায়ুর পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ।

জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত প্রভাবে পৃথিবী কখন, কীভাবে এবং কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে আমরা কেউই তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। তবে বর্তমানে আমাদের প্রত্যাহিক জীবন যাপনে জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। অনাবৃষ্টিতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে কৃষি চাষ ব্যবস্থা ফলে চাহিদার তুলনায় খাদ্য উৎপাদনও কম হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা বেশি থাকায় নিত্য পণ্যের দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে তাপমাত্রা অত্যাধিক পরিমানে বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের জীবন যাপন বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।

পৃথিবীর কোথাও অতি বৃষ্টির ফলে ব্যাপক বন্যা দেখা যাচ্ছে এবং কোথাও কোথাও দাবানলে বনজঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এমনকি লোকালয়েও মানুষ পুড়ে ঘরবাড়িও পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই কিছু ভয়াবহ দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে যেমন- লিবিয়ায় ঘুর্নিঝড় ও বন্যা, ভারতের অগ্রা ও অরুনাচলসহ বিভিন্ন প্রদেশে অতিমাত্রায় বৃষ্টিতে বন্য ও ভুমিধস, বাংলাদেশর চট্রগ্রাম শহরে বন্য ভুমিধস, কানাডায় দাবানল, আমেরিকায়, ফিলিপাইন ও চীনে বড় বড় সাইক্লোনসহ অনেক বিপর্য়য় দেখা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথা অনুযায়ী, শিল্প বিপ্লবশুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। ফলে শিল্পবিপ্লব মঙ্গলজনক হলেও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যেই পৃথিবী আমাদের উপর অশুভ আচরণ শুরু করেছে। দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে বাংলাদেশও কম বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে অত্যাধিক ঝুঁকিতে থাকা দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম।জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিপদাপন্নতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এই বিপদাপন্নতার সাক্ষী স্বরুপ যে প্রভাবসমূহ পরিলক্ষিত যেমন-বিগত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন ঋতুর আগমন এবং প্রস্থানের সময়কালের সামান্য পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন-আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল হলেও আশ্বিন মাসেও ভারী বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায় এবং অসময়ে বন্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে, পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল হলেও ফাল্গুন ও চৈত্র মাস পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলে রাতে প্রচন্ড শীত অনুভূত হয়।

গ্রীষ্মকালে কখনও কখনও তীব্র গরম পড়ে এবং তা একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত বিরাজমান থাকে, যাকে তাপদাহ বা দাবদাহ নামে অভিহিত করা হয়। এই তাপমাত্রা কোনো কোনো অঞ্চলে ৪৫ -৪৮ শুণ্য ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। ফলে গ্রীষ্মকালে অস্বাভাবিক গরমে মানুষের জীবন ও জীবিকায়নে দেখা যাচ্ছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। অত্যাধিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুকুরে মাছ চাষ, কৃষির উৎপাদনে পানির অভাব, বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদন ব্যহত হয়ে খাদ্যে স্বল্পতা সৃষ্টি হচ্ছে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে প্রচন্ড গরম ছড়িয়ে পড়ছে,ফলে মানুষের স্বাস্থ্যগত নানা রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত (০৭ জুলাই ২০২৩) বিজ্ঞানীদের একটি বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, ২৯ জুন থেকে ৫ জুলাই ২০২৩ (সাতদিন) ছিল ৪৪ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রায় সবচেয়ে উষ্ণতম সপ্তাহ। ৫ জুলাই ২০২৩ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অনানুষ্ঠানিকভাবে সর্বোচ্চ ৬২ দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১৭ দশমিক ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) রেকর্ড করা হয়েছে।এটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের চরমসীমার সর্বশেষ ভয়াবহ মাত্রা বলা হচ্ছে।সাধারণত ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৮৪.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর অধিক তাপমাত্রাকে বিপজ্জনক তাপমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সুতরাং অবস্থা কোথায় এসে দাড়িয়েছে এবং আগামীতে কোথায় গিয়ে দাড়াবে তার অনুমান আতংকিত হবার মতো। বিজ্ঞানীদের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ৬ কোটি মানুষ ইতোমধ্যে বিপজ্জনক তাপমাত্রার ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। যদি জলবায়ুর উষ্ণতা আরও তীব্র হয়- বর্তমান পরিস্থিতিতে যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলো প্রায় ৩৩০ কোটি মানুষ এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ চরম তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে পারে। সুতরাং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিরসনে উপযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা জরুরী।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ।আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, কেউ যদি সৃষ্টিজগতের স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তখনই  প্রকৃতি তার বিরুপ আচরণ শুরু করে। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত যে মহাদুর্যোগের সূত্রপাত ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তা এককথায় মানবজাতির জন্য বিরাট অভিশাপ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের নির্মমতা ও নির্দয়তার প্রতিশোধ নিতেই প্রকৃতি নিজেই খেপে উঠেছে।জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মহাবিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের করণীয় হিসেবে দেশের জনগণকেও সচেতন থেকে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে।

পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বন-জঙ্গল সুরক্ষাসহ সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে ও সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে। এছাড়াওকলকারখানায় কালো ধোঁয়া নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে, সিএফসি নির্গত হয়- এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমাতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে, বনভ‚মি ধ্বংস বন্ধ করতে হবে, বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বাড়াতে হবে, সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করতে হবে এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুঝুঁকি কমাতে পরিবেশবিনাশী কর্মকান্ড সর্বাগ্রে বন্ধ করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সরকারি বেসরকারি ভাবে সমন্বিত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য সামাজিক আন্দোলনসহ গণসচেতনতা বাড়াতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমতনির্বিশেষে সবাইকেই সজাগ হতে হবে। প্রয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট গঠন করে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। উপরোক্ত উদ্যোগেই জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি সমন্বয় করা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে ধরে নেয়া যায়।

লেখক- উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা।

নিউজটি শেয়ার করুন


এ জাতীয় আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়