সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর ►
সাদা পদ্ম, গোলাপী শাপল আর কচুরিপানার ফুলের চাদরে ঢেকে গেছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ আশুরার বিল। সাদা বক, পানকৌটি পাখি আর অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারদিক। আশুর বিলের তীর ঘেষা বিশাল শাল বনের রয়েছে সেগুন, গামার, কড়ই ও জাম গাছে নতুন পাতার রঙ। এক কথায় দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে অবস্থিত আশুরার বিল ও শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যানে এখন সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য এক মনোরম পরিবেশ।
গত দুই বছর করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশে চলছে সাধারণ ছুটি। এ কারণে বিল ও বনে দর্শনার্থীদের পদচারণা ছিলনা। সেই সময় থেকে প্রকৃতি যেন নিজস্ব রুপ ফিরে ফেয়েছিল। তা এখন পর্যন্ত ধরে রাখায় এ সময় প্রকৃতিতে দেখা যাচ্ছে নতুন সাজ। বিভিন্ন প্রজাতির পাক পাখির বিচরণ করছে। শাপলা, পদ্মসহ কচুরিপানার ফুলে ফুলে ভরে গেছে বিলের পানি। সুনসান নীরবতা ও পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চারদিকে দারুণ আবহ।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রশাসনিকভাবে পর্যটক উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছিল আশুরার বিলে। জনসমাগম বন্ধ হওয়ার দুই মাসে বদলে গেছে বিল ও বনের রূপ। এখন বেশ অপরূপ লাগছে জায়গাটি। জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে বিল ও বন। করোনার পাদুরভাব কিছু নিয়ন্ত্রনে আসায় আশুর বিলের সৌন্দর্য আর কাঠের তৈরী আকাঁবাঁকা সেতু দেখার জন্য জনসমাগম বাড়ছে ।
স্থানীয় এলাকাবাসী সংবাদকমী আজিম উদ্দীন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে লোকজন আসা বন্ধ থাকায় বিলে ও বনে এখন নিরিবিলি পরিবেশ। তাই প্রকৃতি স্বরূপে সেজেছে। ফলে বিপুলসংখ্যক অতিথি পাখি আসছে। আগেও পাখি আসতো, কিন্তু এত বেশি দেখিনি। বিশেষ করে ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৮টা-৯টা পর্যন্ত গোলাপী ফুলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। রোদের তাপমাত্রা বাড়লে গোলাপী শাপলা ফুলের সৌন্দর্য্য কমে যায় ।
নবাবগঞ্জ বিট কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম মনে করেন, জনসমাগম না থাকার সুবাদে শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলের রূপ বেড়েছে। শাপলা ও পদ্ম ফুলে বিল ছেয়ে গেছে। বনের গাছগুলো নতুন পাতায় সেজেছে। সেই সঙ্গে পরিযায়ী পাখিরা বিল ও বনে মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে নয়নাভিরাম পরিবেশ।
সচেতনভাবে পর্যটন কার্যাবলী পরিচালনা করলে প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন এই বিট কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা দায়িত্বে নিয়োজিত আছি, সবাই যদি সজাগ থাকি তাহলে বিল ও বনটি নতুনের মতো রাখতে পারবো।’
বিট কার্যালয় সূত্র জানায়, ৫১৭ দশমিক ৬১ হেক্টর সংরতি বনাঞ্চল নিয়ে শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান। এতে ২০-৩০ প্রজাতির গাছ রয়েছে। আগে এটি ছিল শালবন। ২০১০ সালে জাতীয় উদ্যান স্বীকৃতি পেয়েছে এই জায়গা। পরবর্তী সময়ে এর নাম রাখা হয় শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান। বনের মধ্যে ৩৬০ হেক্টর এলাকাজুড়ে অবস্থিত দর্শনীয় আশুরার বিলকে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা দেয় কর্তৃপ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যায়।
একসময় অবহেলা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে আশুরার বিলের জৌলুস মলিন হতে বসে। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে থাকা দর্শনীয় এই স্থান উপজেলা প্রশাসন নিজেদের আয়ত্তে নেয়। বিলের পানি ধরে রাখার জন্য রয়েছে ক্রস রাবার ড্যাম। একইসঙ্গে বিল ও বনের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য গড়ে তোলা হয় দেশের বৃহত্তম জেড আকৃতির ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আঁকাবাঁকা কাঠের সেতু। এরপর থেকে আশুরার বিল ও জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে।
লাল-সাদা শাপলা ফুলে ছেয়ে গেছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের সংলগ্ন আশুরার বিল। দূর থেকে দেখে মনে হবে লাল ও সাদা চাদরে মোড়ানো একটি জলাশয়। যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে অঙ্কিত স্থিরচিত্র। আর বিলের পানিতে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য শাপলা ফুলের সমাহার উপভোগ করতে প্রতিনিয়ত আশুরার বিলে ভিড় করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
আশুরার বিল নবাবগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের ৫৮৮ দশমিক ২২ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বিলের একাংশে শাপলা বিলটির অবস্থান। যেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় লাল-সাদা শাপলার সমাহার থাকে। যার সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে।
আশুরার বিলে বেড়াতে আসা শিার্থী জিন্নাতুল কবির বলেন, সকালে বিলে আসলেই দেখা মিলে রং-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখা যায়। বিলের যত দূর চোখ যায়, তার পুরোটা জুড়েই এখন সাদাপদ্ম আর গোলাপী শাপলার সমাহার। কিন্তু ফুলের এ দৃশ্য টিকিয়ে রাখতে বিলটি সংস্কার করা প্রয়োজন।
নবাবগঞ্জের দাউদপুর বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক একরামুল হোসেন বলেন, ফুল হচ্ছে পবিত্র সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুলকে ভালোবাসে না এমন মানুষ কম আছে। বেশির ভাগ ফুল গাছে শোভা পায়। কিন্তু পানিতে শোভা পায় শাপলা ফুল। খালবিলের পানিতে দেখা মিলে এই ফুলের। দিনদিন খালবিল কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে এ ফুলের সমাহার। কিন্তু আশুরার বিলে দেখা মিলে বিপুল পরিমাণ শাপলা ফুল। ফলে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আশুরার বিলে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন প্রকৃতিপ্রেমিকরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ সোম বলেন, নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের সুবিশাল শালবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই বন ঘেঁষে ঐতিহ্যবাহী আশুরার বিলের অবস্থান। বন ও বিলের সহাবস্থান আশুরার বিলকে অনন্যতা দিয়েছে ও চিত্তাকর্ষক করেছে। শাপলা ফুল এ সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে তুলেছে। সম্প্রতি আশুরার বিলটি খননের পদপে গ্রহণ করা হয়েছে। খনন হলে আরো বিপুল আকারে এ ফুলের দেখা মিলবে।
দিনাজপুর-৬ আসনের সাংসদ শিবলি সাদিক বলেন, নবাবগঞ্জের এই আশুর বিলের সৌন্দর্য্য আরোও বৃদ্ধি ও আর্ন্তজাতিক মানের ভ্রমন স্থান করার জন্য ১২ হাজার কোটির টাকার প্রকল্প হাতে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে আশুরার বিল খননসহ থ্রি-ডি ব্যবস্থা। খনন হলে আরো বিপুল আকারে এ ফুলের দেখা মিলবে। নবাবগঞ্জের আশুর বিলের লাল শাপলা আর সাদা পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য্য ভ্রমন পিপাপু মানুষের নিকট বাড়তি আনন্দ যোগ করতে পারবে ।