আশরাফুল আলম
গাইবান্ধা উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম জেলা। মূল মহাসড়ক থেকে এই জেলা একটু বাইরে থাকায় কেউ কেউ এই জেলাকে পকেট জেলাও বলে থাকেন। বৃহত্তর রংপুর বিভাগের আওতায় দক্ষিণে এই জেলার ভৌগোলিক অবস্থান। জেলা শহরের প্রায় ১০ কিঃ মিঃ পূর্ব দিকের ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদী। জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা আর দক্ষিণে সাঘাটা উপজেলার পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। এই সকল নদী জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমিকে বিভক্ত করেছে। কোথাও কোথাও বিশাল আকৃতির বালুচর জেগে উঠে ব-দ্বীপ ভূমির সৃষ্টি হয়ে মূল সমতল ভুমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। জেলায় প্রায় ১৬৫টি ছোট বড় চরের প্রকাশ ঘটেছে। জেলার মূলতঃ সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি এবং সাঘাটা উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের মধ্যে এই সকল চরের বিস্তৃতি। একটি দৈনিক পত্রিকার খবরে জানা গেছে, জেলার ১৬৫টি চরে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ বাস করে। জেলায় লিঙ্গভিত্তিক সাক্ষরতার শতকরা হার ৬৬.৮৭%।
জাতিসংঘের এসডিজি’র ঘোষণার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন নির্ধারিত করা হয়েছে। এই সময় ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এসডিজি’র লক্ষ্যের মূল শ্লোগান হলো, ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব হবে সুরক্ষিত, দুর হবে দারিদ্র, শিশু এবং নারীদের প্রতি থাকবে না কোনো বৈষম্য এবং পৃথিবীর সব মানুষ শান্তি এবং সমৃদ্ধি ভোগ করবে। এই লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো আর মাত্র সাত বছর রয়েছে এসডিজি’র স্বপ্ন পুরণের। স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্য নিয়ে সরকারও ছোট-বড় বিবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, যার ফল মূল ভূখ-ের মানুষ ভোগ করতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের চরাঞ্চলের অনেক মানুষ দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাস করছে বিভিন্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলে। বিশাল অংশের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন আটকে আছে নানাবিধ সমস্যার মধ্যে। তাদের নিয়ে সরকারি বেসরকারি ভাবনার জায়গাটি অতি নগণ্য। অর্থাৎ এই জনগোষ্ঠী এসডিজি মূল স্রোতে এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়নি।
স্বাধীনতাউত্তোর বাংলাদেশে যেসব বিষয়ে পরম অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা। শিক্ষার মান নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু শিক্ষার সম্প্রসারণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তারপরও বিশাল অর্জনের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবহেলা কিংবা উপেক্ষা রয়েই গেছে। সেই উপেক্ষিত অঞ্চলগুলো কিংবা জনপদের মধ্যে চরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা বেশ নাজুক। চরবাসীর বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা দেখা যায় তা দীর্ঘদিনের। প্রাকৃতিক সমস্যার সাথে মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম সমস্যা যুক্ত হয়ে জীবনের গতিই ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়। চরের শিক্ষার্থীগণ একই কারিকুলামভুক্ত হয়েও শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতল ভুমির শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে। এখানকার ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পার হতে পারে না। মেয়েদের বাল্য বিয়ে হয়ে যায়, আর ছেলেরা জীবিকার তাগিদে পরিবারের চাপে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। বন্যা এবং নদী ভাঙ্গনের কারণে বছরে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখতে হয়; অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কোন সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি অথবা সেই আর্থিক ও জ্ঞানের সমৃদ্ধি এখনও হয়ে ওঠেনি, ফলে যেকোনো ধরনের বৈরী অবস্থায় পাঠদান থমকে যায়।
বিভিন্ন তথ্যসুত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার চরাঞ্চলের ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। যারা ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকের গ-ি পেরুতে পারে না। এর পিছনে দারিদ্র্য, চর এলাকার অভিভাবকদের অসচেতনতা, চ্যালেঞ্জিং যাতায়াত ব্যবস্থা এবং বাল্যবিবাহ অন্যতম। তিস্তা, যমুনার চরাঞ্চলের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে আর পড়াশোনা করে না। কারণ হিসাবে তারাও বলেছেন, বাড়ির কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অন্য চরে বা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে খরচ যোগান দেয়া পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রতিদিন অভিভাবকদের সামর্থ অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে দিতে হয় ৫০-১০০ টাকা। যেসকল সচেতন অভিভাবকদের সামর্থ আছে, কেবল তারাই সন্তানদের শহরে আবাসিক হোস্টেল বা মেসে রেখে পড়াশুনা করাতে পারেন। এত মানুষের বসবাসকৃত চরে একটিও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। এ থেকে আমরা বলতেই পারি ইচ্ছে থাকলেও যেন উপায় মিলছে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা এবং নদীভাঙ্গন এইসব চরের শিক্ষা ব্যবস্থার পথে আর একটি অন্যতম বাঁধা। প্রতিবছর বন্যার ফলে পানির তোরে বালুচর ভেঙ্গে গিয়ে স্কুলের মাঠ কিংবা স্কুল ঘর এবং উকরণসমূহ বিনষ্ট হয়ে লেখাপড়ার অনুপযোগী হয়ে পরে। এছাড়া স্কুলে যাবার রাস্তার মাটি সরে গিয়ে গর্ত হয়ে গেলে বিদ্যালয়ে গমনের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরিবেশ নষ্ট করে। প্রাকৃতিক বিপদাপন্নতার পাশাপাশি চরে দীর্ঘদিনের সমস্যা শিক্ষক সংকট অথবা পরিবর্তিত তুলনামূলক কম শিক্ষিত ব্যক্তিকে দিয়ে পাঠ দান করা। সমতল ভুমি থেকে প্রতিটি চরের দূরত্ব এতোবেশি যে একজন শিক্ষকের পক্ষে নদী-নালা পার হয়ে পাঠদানের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া মাথায় যাওয়া এবং ফিরে আসার সময় চিন্তা নিয়ে পড়ার চেয়ে ঘড়ির কাটাই যেন মূল চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থার মধ্যেই গাইবান্ধার চারটি উপজেলার প্রায় ৩১,৯৪২ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন চলছে সমতল ভুমির শিক্ষার্থীর চেয়ে কচ্ছপের গতিতে। মেধাবী হবার পরও যেন অবস্থার বৈরীতায় যথাযথ জ্ঞানের বিস্তৃতি থেকে পিছিয়ে পড়ছে অনেকেই। গাইবান্ধার চরাঞ্চলে এবং সমতল ভুমির সাথে সংযুক্ত চরে ১১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি মাধ্যমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারে অনিয়মিত। চাহিদার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম না হলেও দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে যথেষ্ট। ফলে প্রাথমিকের গ-ি পেরোতেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ঝরে পড়ছে অকালে।
চরম সত্যি যে চরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে অন্ধকারে রেখে জাতীয় উন্নয়ন আশানুরূপ হবে না। দেশের সব শিশুর সমান অধিকার আছে শিক্ষা গ্রহণের। চরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থী যথেষ্ট মেধাবী। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাইবান্ধার চরের শিক্ষার্থীদের বিচরণ রযেছে। জন্ম নিয়তি নির্ধারিত হলেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকার সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছে আমাদের আশা চরাঞ্চলের শিশু-কিশোরদের জন্যও সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্ণতা দেবে। আমরা যে সমাজ গড়ে উঠার সম্ভাবনা আর স্বপ্ন দেখি আংশিক জনপদকে শিক্ষার বাইরে রাখলে সেই সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে না। সামগ্রিকভাবে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার জন্যও সবার জন্য নিশ্চিত হোক শিক্ষার সমান সুযোগ। আমাদের মনে করতে হবে, সমস্যা যেখানে আছে সমাধানের পথ সেখানেই খুঁজে বের করতে হবে। সুতরাং পরিকল্পিত চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই সমাধান আনয়ন সম্ভব। এলাকার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সমস্যা সমাধানে কিছু সম্ভব্য সম্ভাবনার প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।
যেমন- বিদ্যালয় সংলগ্ন চর সমুহের ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ;
► চর ভিত্তিক স্থায়ীত্বশীল চরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন;
► শিক্ষকের পাঠদানের দক্ষতা বৃদ্ধি করণ এবং স্থানীয় শিক্ষক নিয়োগ/পোস্টিং দেওয়া;
► শিশু বিবাহ প্রদানে নিরুৎসাহিত ও আইনের শাস্তির প্রচারণায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা;
► বন্যার সময় বিদ্যালয় খোলা রেখে বিকল্প স্থানে আশ্রয় কেন্দ্র করা অথবা বিকল্প ব্যবস্থায় পাঠদান অব্যহত রাখা;
► দারিদ্রতা হ্রাসে পরিবারের নারী ও পুরুষ উভয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা;
► শিক্ষক সংকট নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ;
► ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ এবং শিক্ষা বিভাগকে যথাযথভাবে অবহিত করা;
► চরের প্রেক্ষপট বিবেচনায় নীতিমালায় শিথিলতায় বিশেষ অনুমোদনে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা;
► তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি;
► বর্ষা মৌসুমে বিদ্যালয়ে গমনের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করা;
► চরের কর্মরত শিক্ষক অথবা এসংক্রান্ত কর্মকর্তাগণের অতিরিক্ত ভাতার ব্যবস্থা করা;
► শিক্ষকদের জন্য আবাসিক থাকার ব্যবস্থাকরণ;
► মনিটরিং ব্যবস্থার কৌশলগত উন্নয়ন ও জোরদার করণ;
► দুর্গম যাতায়ত ব্যবস্থা হওয়ায় তুলনামূলক পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যা বেশি রাখা;
► সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনি কর্মসূচির প্রসর;
► দুর্বল শিক্ষার্থীর উন্নয়নে বেসরকারিভাবে খন্ডকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন;
► স্থানীয় সরকারের স্তর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ;
► স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে স্কুলে যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট রাস্তা অথবা পানি ও পয়নিস্কাসনের প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যবস্থার উন্নয়ন;
সুতরাং যদি চরের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর চিন্তা করতে হয় তবে উপরোক্ত বিষয়াদি মাথায় নিয়ে তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এমন অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
লেখক- উন্নয়ন কর্মী, গাইবান্ধা।