Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২৭-১২-২০২৩, সময়ঃ বিকাল ০৪:২৫

প্রসূতিদের মমতার ঠিকানা পদুমশহর মডেল স্বাস্থ্যকেন্দ্র

প্রসূতিদের মমতার ঠিকানা পদুমশহর মডেল স্বাস্থ্যকেন্দ্র

আবু সায়েম

মাত্র বছর তিনেক আগেও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। নামমাত্র স্বাস্থ্যসেবা পেত রোগীরা। অন্য রোগীদের মতো প্রসূতিরাও সব সময় ছুটতেন শহরের দিকে। সিজারে বাড়তি খরচের পাশাপাশি ঝুঁকি থাকত মা ও নবজাতক শিশুর। কিন্তু মাত্র ২-৩ বছরের সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবা কার্যক্রম। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসবে (নরমাল ডেলিভারি) ১০৭৪ শিশুর জন্মগ্রহণের রেকর্ড গড়েছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। আর তাই এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি প্রসূতিদের কাছে নিরাপদ সন্তান প্রসবের এক আপন ঠিকানা হয়ে উঠেছে।

আলোচিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি হলো ‘পদুমশহর মডেল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র’। গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে জেলার সাঘাটা উপজেলার পদুমশহর ইউনিয়নের স্কুলের বাজারে অবস্থিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। অল্প দিনেই এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে জেলাজুড়ে। এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি মায়েরা আসেন নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য। আর তাই এখন শুধু পদুমশহর ইউনিয়নের প্রসূতিরাই নন, আশপাশের ইউনিয়ন এবং জেলা-উপজেলার মায়েরাও আসেন এখানে সেবা নিতে। 

কিন্তু হঠাৎ কীভাবে বদলে গেল এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। সম্প্রতি গাইবান্ধা থেকে কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে পদুমশহর মডেল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি ঘুরে দেখেন। এ সময় সংশ্লিষ্টরা সাংবাদিকদের জানান, বছর তিনেক আগেও এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি অন্যান্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতই চলত। জরাজীর্ণ পরিবেশে নামমাত্র সেবা পেত রোগীরা। কিন্তু ২০২১ সালের এপ্রিলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসকেএস ফাউন্ডেশন বাস্তবায়িত ‘মমতা’ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় দুইজন মিডওয়াইফ, একজন আয়া, একজন নৈশপ্রহরী এবং একজন টেকনিক্যাল অফিসার (টিওসিবিএফ) নিয়োগ দেওয়া হয়। সেইসাথে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সকল ধরনের যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা হয়। এরপর থেকেই গর্ভবতী নারীদের প্রসব পূর্ববর্তী, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবার মাধ্যমে নতুন করে পরিচিতি পায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি।

পদুমশহর ইউনিয়নের ডিমলা এলাকার প্রসূতি রাশেদা বেগম (২৪) বলেন, “আগে তো হামরা হ্যাটাই কোনো দিনও আসি নাই। হামার এক আত্মীয়র এটি নরমাল ডেলিভারি হইচে। তার কাছ থাকি এ ঠ্যাক্কার কথা শুনি আসি। তারপর থাকি আপাদের কথামত দরকারি টেস্ট করি। আল্লার রহমতে আমারও মমতা ক্লিনিকত নরমাল ডেলিভারি হয়। হামরা এ ঠ্যাক্কার সেবা পায়া খুব খুশি।”

পার্শ্বর্তী সদর উপজেলার বাদিয়াখালী এলাকার গৃহবধু আঞ্জু খাতুন (২৬) বলেন, আমি যখন চার মাসের গর্ভবর্তী তখন মমতার আপারা গ্রামে আসিয়া মিটিং করে আমাদের সেবা দেওয়ার কথা বলে। পরে প্রথম চেক-আপ করার জন্য ক্লিনিকে যাই। ওখানে আপারা আমার রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা করে, প্রেসার আর ওজন মাপে। আবার দ্বিতীয় বেলাতেও এভাবেই সেবা নেই। যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে পেটে বাচ্চা ভালো আছে কি-না। মমতা ক্লিনিকে যাই। ওখানেই আমার নরমাল ডেলিভারি হয়। ওষুধপাতি যা কিছু লাগে সব বিনামূল্যে করে দেন। আমরা চাই যেন এটা দীর্ঘমেয়াদি থাকে। আমরা এভাবে যাতে সেবা নিতে পারি।”

পদুমশহর ইউনিয়নের ট্যাপাকানিপাড়া গ্রামের সেবাগ্রহীতা রাশেদা বেগম বলেন, “মমতা ক্লিনিকের জইন্যে হামার মতোন গরীব মাইনষের ম্যালা উপকার হইচি। বাড়িত ডেলিভারি হইতি গর্ভবতীরা ভয়ে থাকত। ফির আবার শহরত যায়া ক্লিনিকত সিজার কইততে ম্যালা ট্যাকা নাইগত।”

পদুমশহর মডেল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডবিøউভি) ফরিদা পারভিন বলেন, “ আমরা একজন গর্ভবতী মা’কে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়ে বাড়িতে গিয়েও সেবা দেই। তাদের চারটি চেক-আপ নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। সেইসাথে তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সব তথ্য আমরা সংগ্রহে রাখি। সে অনুযায়ী তাদের পরামর্শ দেই। এ পর্যন্ত আমরা এ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মোট ১০৭৪টি ডেলিভারি করেছি। এগুলো যে শুধুই এই অঞ্চলের তা নয়। জেলার বাইরে থেকেও অনেকে এমন আছেন। মাত্র কয়েকজন প্রসূতিকে আমাদের জেলা হাসপাতালে রেফার্ড করতে হয়েছে।”

পদুমশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুল হক বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের গর্ভবতী মায়েরা এখান থেকে বিনামূল্যে সেবা পাচ্ছেন। আমাদের ইউনিয়নও বাড়তি পরিচিতি পাচ্ছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করে আসছি।

মমতা প্রকল্পের সমন্বয়কারী বাহারাম খাঁন বলেন, মা ও শিশু মৃত্যুহার রোধে সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মমতা প্রকল্পই হয়ে উঠেছে একটি সেতুবন্ধন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এবং কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কইকা) এর আর্থিক সহায়তায় এসকেএস ফাউন্ডেশন ‘মমতা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। ২০২১ সাল থেকে আমরা গাইবান্ধা জেলার চারটি উপজেলা সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে এ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছি। 

তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত আমাদের ১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মোট ২ হাজার ৬৫৭টি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে আমাদের এই প্রজেক্ট শেষ হবে। তবে আমরা আশা করি প্রকল্পটি আরও দীর্ঘ মেয়াদে বাড়বে। আমাদের লক্ষ্য বাড়িতে শূণ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করা।

পরিবার-পরিকল্পনা গাইবান্ধার উপ-পরিচালক প্রসেনজিৎ প্রণয় মিশ্র বলেন, মমতা প্রকল্পের পরিচালনায় ১১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী মায়েদের সেবা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পদুমশহরে রেকর্ড সংখ্যক প্রসূতির স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। যা এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা আশা করি যে মমতা প্রকল্পের সহযোগিতা পেলে জেলার অন্যান্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad