ভবতোষ রায় মনা ►
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের ৪২০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ২২ হাজার পরিবার বতসবাড়ির পতিত জমিতে সবজি আবাদ করেছে। চরের ৮০ ভাগ নারী সবজি চাষের সাথে সর্ম্পৃক্ত বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: বেলাল উদ্দিন।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর দুর্গম চরে পরিত্যাক্ত জায়গায় সারাবছর শাক-সবজি আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন চরের নারীরা। উপজেলার এরেন্ডবাড়ী, ফজলুপুর, ফুলছড়ি, উড়িয়া, উদাখালী, কঞ্চিপাড়া ও গজারিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৬৫টি দ্বীপ চর রয়েছে। এসব চরের পরিত্যাক্ত ও বসতভিটার ফাঁকা জায়গার উর্বর মাটিতে ফসল আবাদ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে কৃষাণীরা। লাউ, মাসকলাই, সরিষা, মুগডাল, শিম, পালং শাক, লাল শাক, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনে পাতা, ঢেঁরশসহ নানা জাতের শাক-সবজি চাষ করেছেন তারা।
নদীভাঙ্গন, বন্যাসহ নানা ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে এসব চরের মানুষের সারাবছরই দিন কাটতো অভাব অনটনে। সরকারি দপ্তর ও স্থানীয় এনজিও’র বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩৫টি চরের মানুষ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাল্টে গেছে তাদের জীবন যাত্রার মান। বাড়ি ও রাস্তার পাশে পরিত্যাক্ত স্থানে বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি আবাদ করে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন চরের নারীরা।
চরাঞ্চলের উৎপাদিত ফসল ওই অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্রিও হচ্ছে। বন্যার পরবর্তী মাঠে কোন ফসল না থাকায় যখন পরিবারগুলি অর্থ সংকটে থাকতো তখন শাক-সবজি বিক্রির অর্থে সংসারের এসেছে স্বচ্ছলতা। গৃহিণীরা শাক-সবজি বিক্রি করে সংসারের টুকিটাকি খরচের পাশাপাশি সন্তানদের পড়ালেখার খরচও যোগাচ্ছেন।
চর কাবিলপুরের সোনাভান বেগম জানান, বাড়িত এগলা (সবজি) আবাদ করি দু’পয়সা রোজগার হবা নচে। তাক দিয়্যা সংসারের টুকিটাকি খরচ, ছোলগুলার নেহাপড়ার খরচও চলবার নচে। শুধু সোনাভান নয়, কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চরের প্রায় ২২ হাজার পরিবারের নারীরা এ ধরণের সবজি চাষের সাথে জড়িত। তাদের উৎপাদিত সবজি উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে জেলায়।
এরেন্ডবাড়ী ইউনিয়নের আলগার চর গ্রামের নারী কৃষক আকলিমা বেগম বলেন, হামরা আগোত কৃষি অফিস থাকি প্রশিক্ষণ নিচি, তার পরে হামার বসতবাড়ীর চারদিকে পরি থাকা জমিগুলাত বস্তার মধ্যে লাউ গাছ, ঘরের পিছনে বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি নাগাই। জমিত থাকি শাক-সবজি তুলি নিজেরাও খাই, আবার বেচিওয়া দু‘টাকা পাই। এতে হামাঘরে সংসারোত অভাবটা নাইয়ো। গেদার বাপ (ছেলের বাবা) মানুষের জমিত সারাদিন কাম করে। তাইও যেকনা কামাই করে ওকনাও সংসারের কাজোত নাগে।
ফজলুপুরের খাটিয়ামারি গ্রামের কৃষাণী শাফলা বেগমের স্বামী আফজাল হোসেন জানান, প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে দো-আশ মাটি ভরি ওই মাটির মাঝ খানে দু‘টা লাইয়ের বিচি নাগাই। লাউ গাছ বড় হলে বাঁশের খুটির ওপর সিংটা (পাটকাটি) দিয়্যা জ্যাংলা বানেয়া জ্যাংলার ওপর লাউ গাছের ডগা তুলি দেই। লাউ ধরলে লাউগলা ঝুলি থাকলে, লাউ গুলা ভন ভনে বড় হয়। শুরুত থাকি আজকা পর্যন্ত ৫ হাজার ট্যাকার লাউ বেচচি। আরও হাজার খানেক ট্যাকার লাউ জ্যাংলাত আছে।
ফুলছড়ি ইউনিয়নের চর পিপুলিয়া গ্রামের ময়নুব বেগম বলেন, স্বামী সারাদিন কাজ করিয়া যেকনা টাকা পায়, তাক দিয়্যা ঠিকমতো সংসার চলে না। হামার সংসারোত নুন আনতে পন্তা ফুরায়। হামরা মহিলাগুলো বাড়িত বসি থাকি কি করমো, তাই এলাকার একটা এনজিও থাকি সবজির আবাদের প্রশিক্ষণ নিয়্যা ম্যালা উপকার হচে। এখন বাড়ির আগে-পাচে পড়ি থাকা জমিগুলাত পেঁপের গাছ, শিম, পালং শাক, লাল শাক, মরিচ, ধনিয়া পাতা, ঢেঁরশ আবাদ করবার নাগচি। এতে করি নিজের খাওয়াও হয়, ফির বাজারোত বেচি টাকাও হাতোত আসপার নাগচে। এখন হামাঘরে সংসারোত অভাব ম্যালা কমি গেছে।
ফুলছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: মিন্টু মিয়া জানান, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ৪২০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। বছর প্রথম ধাপে কৃষি অধিদপ্তর থেকে ১২২টি পরিবারের মাঝে উন্নত জাতের সবজি বীজ বিতরণ এবং ২য় ধাপে ১৪৪টি পরিবারের মাঝে সবজি বীজ বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি নারী কৃষকদের কারিগরি পরার্মশও দেওয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: বেলাল উদ্দিন বলেন, চরের বসতবাড়ির আশেপাশে কৃষকরা সবজি চাষাবাদ করে তাদের যেমন অর্থনৈতিক চাহিদা মিটছে পাশাপাশি তাদের পুষ্টির ঘারতিপূরণ হচ্ছে। চরাঞ্চলে পরিবহন ও সংরক্ষণের সমস্যা কারণে কৃষকরা ন্যযমূল্যে পায় না। সেক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কোল্ডস্টোর বা সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে চরাঞ্চলে শাকসবজি চাষে ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে।