Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • ২২ ঘন্টা আগে
  • ১৩০ বার দেখা হয়েছে

বাংলা নাট্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র তুলসী লাহিড়ী

বাংলা নাট্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র তুলসী লাহিড়ী

মনজুর হাবীব মনজু

বিশ শতকের মাঝামাঝি প্রথমার্ধেরর বেশি সময় ধরে সমগ্র বাংলা সংস্কৃতিজগতের প্রধান চারটি স্তম্ভকে একাই দখল করে রেখেছিলেন এক বাঙালী। বাংলা নাটক, চলচ্চিত্র আর সংগীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে স্মরণীয় হয়ে থাকা বাংলাদেশের উত্তর জনপদের গুণবান এই মানুষটি তৎকালীন বৃটিশভারতের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে বহুল পরিচিত পেয়ে অমর হয়ে আছেন। একবারে নিভৃত পল্লির  আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে বাংলা সংস্কৃতি অঙ্গণের শীর্ষে ওঠা এই মানুষটির নাম তুলসী লাহিড়ী। আজ ২২ জুন বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের গাইবান্ধায় জন্ম নেয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষের মৃত্যু দিবস। 

গান লেখা, সংগীত পরিচালনা করার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের কাহিনী রচনা আর অভিনয় একা হাতে উদ্ভাবনের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে মানুষটির জুড়ি মেলা ভার ছিল সে সময়ে। সেই সময়ের চলচ্চিত্র জগতে এই চার ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন অনন্য। এই সবগুলো বিষয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন ভীষণ নিষ্ঠা আর সুনামের সাথে। 

শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ভীষণ অনুরুক্ত ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। গানের জগতে ঘুরে বেড়ানো আর গান শেখার শখও তাঁর তখন থেকেই। গান শেখার হাতেখড়িও তাঁর বাবার কাছেই। বাবা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর কাছে গান শেখার সূচনার পর ওস্তাদ খেলাফত হোসেনের কাছে সঙ্গীতে শিক্ষালাভ করেছিলেন তিনি।

তবে শুধু গানেই নয় অভিনয়েও ছিলো তাঁর ব্যাপক দক্ষতা। গানের সঙ্গে অভিনয়ের নেশাতেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি। তাঁর নাট্যশিক্ষক ছিলেন তারাপ্রসন্ন সান্যাল। রংপুরে ‘পরপারে’ নামের একটি নাটকে তাঁর প্রথম সৌখিন অভিনয়। রংপুরের তৎকালীন সৌখিন নাট্যসম্প্রদায় অভিনীত ‘পরপারে’ নাটকে ভবানীপ্রসাদের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। মিশরকুমারী তাঁর দ্বিতীয় অভিনীত নাটক। রংপুর থাকাকালীন সময়ে এই নাটকটি তিনি পরিচালনাও করেছিলেন। 

তুলসী লাহিড়ী রচিত সর্বপ্রথম দু’টি গান ১৯২৯ সালে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁ সাহেবের উদ্যোগে রেকর্ড করা হয়। কলকাতার রঙ্গমঞ্চ আর্ট থিয়েটারে স্বয়ম্বরা নাটকে সুর সংযোজনা করে ১০০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। কলকাতার এই পেশাদার রঙ্গালয়ে প্রথম অভিনয় করেন আর্ট থিয়েটারের চিরকুমার সভা নাটকের চন্দ্র’র চরিত্রে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁকে অমর করে রেখেছে ‘ছেঁড়া তার’ ও ‘দুঃখীর ঈমান’ নামের নাটক দু’টি। তাঁর এই অমরসৃষ্টি নাটক দু’টিকে আজও নাট্যামোদীরা কালোত্তীর্ণ হিসেবেই জানেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর সহ সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষদের তৎকালীন জীবন-যাপন নিয়ে তুলসী লাহিড়ীর লেখা ও অভিনীত নাটক ‘ছেঁড়া তার’ শম্ভুমিত্রের নির্দেশনায় ও বহুরূপীর আয়োজনে ১৯৫০ সালের ১৭ ডিসেম্বর কোলকাতায় প্রথম মঞ্চায়নের পর থেকেই বিপুল সাড়া ফেলে দেয়। এতে দেবব্রত বিশ্বাস, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মওলানা ইসমাইল, অমর গাঙ্গুলি সে সময়ের দিকপাল অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করেন। 

তুলসী লাহিড়ীর জন্মভিটা নলডাঙ্গার বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করছেন তার প্রপুত্র তন্ময় কুমার লাহিড়ী। তাঁর কাছে জানা গেলো অনেক না জানা কথা। তিনি জানালেন, তুলসী লাহিড়ীর প্রথম নাম ছিলো হেমচন্দ্র লাহিড়ী। গানবাজনা আর অভিনয়ের পাশাপাশি লেখাপড়াতেও তিনি ছিলেন বেশ মেধাবী। আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি কর্মজীবনের শুরুতে রংপুর কোর্টে ওকালতি করতেন। কিন্তু এ পেশায় নিজেকে উপযুক্ত মনে না করে তিনি সংস্কৃতি জগতে মনোনিবেশ করেন বেশ গভীরভাবে। এ সময় স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয়ায় নাম বদলে হয়ে যান তুলসী লাহিড়ী। আর নামের এই মারপ্যাচেই তিনি সম্মুখীন হন ভীষণ বড় ক্ষতির। এই নামের কারণেই পূর্ববঙ্গের মানুষ হিসেবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা নগরীর বালিগঞ্জ, কাশী ও বর্ধমানের বাড়ি-সম্পদ আর কোচবিহারের শীতলকুচির বিশাল ভূমিসম্পদ হারাতে হয় তাঁকে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চিহ্নিত করে পূর্ববঙ্গের লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম, ভোটমারী, ডাউয়াবাড়ি আর পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের সুন্দরদীঘি এলাকার জমিদারীও কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর। পৈত্রিকসূত্রে সব সম্পদের উত্তরাধিকারী হলেও তার ‘মায়ের দাবি’ চলচ্চিত্রের মুনাফা দিয়ে কেনা জমিদারী ছিলো দেবীগঞ্জের সুন্দরদীঘি এলাকার জমিদারী। এখানে নিয়মিত বসা গানের আসরে যোগ দিতেন ভাওয়াইয়া গানের কিংবদন্তী হরলাল রায়।   

১৯৩০ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি এইচএমভি, কলম্বিয়া ও মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। চলচ্চিত্র জগতেও তাঁর প্রবেশ সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায়। ১৯৩৩ সালে মুক্তি পাওয়া  ‘যমুনা পুলিনে’ তাঁর প্রথম সুরারোপিত ছবি। ১৯৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ‘মণিকাঞ্চন ১ম খন্ড’ ছবিতে পরিচালক, অভিনেতা ও কাহিনিকারের ভূমিকায় কাজ করেন তিনি। এরপর বিরহ, মণিকাঞ্চন ২য় খন্ড, কেরানির জীবন,  সোনার সংসার, বাঙালি, অভিনয়, মায়াকাজল, দিগদারি, বেজায় রগড়, হ্যাপী ক্লাব, পরান পণ্ডিত, হালবাঙালা, রিক্তা, ঠিকাদার, পরশমণি, জীবনসঙ্গিনী, বিজয়িনী, এইতো জীবন, মৌচাকে ঢিল, দিগভ্রান্ত, নতুন বউ, ভালবাসা, ফিডার মিকচার, মন্দির, চোরাবালি, বামুনের মেয়ে, রাত্রির তপস্যা ইত্যাদি। এর মধ্যে বিজয়িনী ও চোরাবালি  ছবি দু’টির পরিচালক এবং রিক্তা, ঠিকাদার, মহাসম্পদ, বিজয়িনী, সর্বহারা ছবির কাহিনিকার ছিলেন তিনি। 

চলচ্চিত্রজগতে নির্বাক যুগের ছবিতেই প্রথম অভিনয় শুরু করলেও সবাক যুগের ‘যমুনা পুলিনে’ ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রজগতের পাশাপাশি মতো মঞ্চজগতেও তিনি অনেক নাটকে অভিনেতা, কাহিনিকার ও সুরকারের দায়িত্ব পালন করেন কৃতিত্বের সাথে। তাঁর রচিত ১৬টি কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। তিনি ছবি পরিচালনা করেছেন ১১টি। অভিনয় করেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি ছবিতে। তাঁর শেষ অভিনীত ছবি ‘ক্ষণিকের অতিথি’।

চার পুত্র আর তিন কন্যার মাঝে বর্তমানে বেঁচে থাকা একমাত্র কন্যা অশীতিপর তাপসী লাহিড়ী পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা নগরীর দমদম এলাকায় বসবাস করছেন। আর বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের গাইবান্ধার নলডাঙ্গা উমেশচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বের আর নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন তুলসী লাহিড়ীর জন্মভিটা আগলে রয়েছেন তাঁর উত্তরসূরিরা। তাদের মালিকানাধীন বিশালাকৃতির বিখ্যাত সরোবর পুকুরের পূর্বপাড়ের এই বাড়ির বহুল ব্যবহৃত প্রাচীন কাচারিঘর, নাট্যমঞ্চ আর অর্ধভগ্ন পারিবারিক শিবমন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন আকড়ে বসবাস করছেন নাতি তন্ময় লাহিড়ীসহ বর্তমান প্রজন্মের স্বজনরা। কাচারি ঘরটিতে রাখা আছে তাঁর নানা স্মৃতিময় চিহ্ন। দেওয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্র-নজরুলসহ বিভিন্ন মহামানুষ আর তুলসী লাহিড়ীর বেশ ক’টি ছবি। 

এ ছাড়াও গাইবান্ধা জেলা শহরে তুলসী লাহিড়ীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন নাতনি চন্দনা ভট্টাচার্য। তুলসী লাহিড়ীর চতুর্থ প্রজন্ম প্রপৌত্র. চন্দনা ভট্টাচার্যের পুত্র কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক কিংশুক ভট্টাচার্য বহন করে চলছেন তুলসী লাহিড়ীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। 

১৮৯৭ সালের ৭ এপ্রিল গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গায় এক জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া তুলসী লাহিড়ী তথা হেমচন্দ্র লাহিড়ী ১৯৫৯ সালের ২২ শে জুন, সোমবার, সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে কোলকাতায় পরলোকে গমন করেন। 

তাঁর পূণ্যস্মৃতিতে জানাই গভীর সম্মান আর অতল শ্রদ্ধা। 

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad