এ মান্নান আকন্দ, সুন্দরগঞ্জ►
হরিপুর চরের নৌ-শ্রমিক ছাত্তার মিয়ার ভাষ্য, আজ থেকে ১১ বছর আগে তার পাঁচটি নৌকা ছিল। নৌকার ব্যবসা দিয়ে সে সংসার চালাত। এখন মাত্র একটি নৌকা তার। সেটিও বছরের ৩ মাস মুল নদীতে চলাচল করে। নদী ভরে উঠায় এখন আর নৌকা চলে না। সে কারনে মাঝি মাল্লারা বেকার হয়ে পড়েছে। নদী খনন বা ড্রেজিং করলে হয়তো তিস্তা তার গতিপথ ফিরে পাবে। নদীতে পানি না থাকায় বালু চরে পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নৌকা গুলো।
বেলকা চরের জেলে জয়ন্ত দাসের ভাষ্য, তিস্তা নদীতে এখন আর জল থাকে না। পলি জমে নদী ভরে গেছে। নদীতে আর মাছ ধরার কোন সুযোগ নেই। এক যুগ ধরে আমরা জেলেরা তিস্তা নদীতে আর মাছ ধরতে পারি না। সে কারনে অনেকে বাজারে খামারিদের চাষকরা মাছের ব্যবসা করছে। আবার অনেকে রিস্কা, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে।
নদী খনন, ড্রেজিং, সংস্কার, শাসন, সংরক্ষণ না করার কারণে তিস্তায় চরম নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও পলি জমে ভরে উঠেছে তিস্তা নদী। খরস্রোতি অগভীর ভরা তিস্তা এখন মরায় পরিনত হয়েছে। নাব্যতা সংকটে ২০ রুট নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজারও নৌ- শ্রমিক ও জেলে সম্প্রদায়।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ি, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী স্বাধীনতার পর আজও ড্রেজিং এবং খনন করা হয়নি। সে কারণে তিস্তা ভরাট হয়ে এখন আবাদী জমিতে পরিনত হয়েছে। তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে অসংখ্য শাখা নদীতে রুপ নিয়েছে। বছরে মাত্র ৬ মাস মুল নদীতে নৌকা চলাচল করে। গোটা বছর পায়ে হেঁটে পারাপার করতে হয় চরবাসিকে।
এক সময় উপজেলার পাঁচপীর, বেলকা, মীরগঞ্জ ও তারাপুর খেয়োঘাট হতে পীরগাছা, কাউনিয়া, উলিপুর, কুড়িগ্রাম, কাশিমবাজার, চিলমারি, রৌমারি, মোল্লার চর, ভূরুঙ্গামারি, দেওয়ানগঞ্জ, কামারজানি, গাইবান্ধা, সাঘাটা, ফুলছড়ি, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, বালাশিঘাট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ রুটে নৌ-চলাচল করত। বর্তমানে নাব্যতা সংকটে সবরুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তিস্তায় হাজারও নৌ-শ্রমিক ও জেলে সম্প্রদায় নৌকা চালিয়ে এবং মাছ ধরে সংসার চালাত। সেই সব জেলে ও নৌ-শ্রমিকরা এখন বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকে বাপ দাদার পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা জড়িয়ে পড়েছে।
বাদামের চরের ব্যবসায়ী ফরমান আলীর ভাষ্য, জেলা ও উপজেলা শহর হতে কাপাসিয়া ইউনিয়নের বাদামের চরের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বিভিন্ন যানবাহনে জেলা ও উপজেলা শহর হতে মালামাল নিয়ে এসে ব্যবসা করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ঘোড়ার গাড়ি ও পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে চরের মধ্যে চলাচলের কোন মাধ্যম নেই। আজ থেকে ১৫ বছর আগে নৌ-রুটে মালামাল আনা নেয়া করা হত।
বেলকা চরের কৃষক শিপন মিয়ার ভাষ্য, নদীতে পানি না থাকায় এখন পায়ে কষ্ট করে চলাচল করতে হচ্ছে। চরাঞ্চলে চলাচলের এখন কোন মাধ্যম নেই। নাব্যতা সংকটের কারনে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
তারাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, তিস্তা নদী এখন আবাদি জমিতে পরিনত হয়েছে। উজানের পলি জমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে অসংখ্য শাখা নদীতে রুপ নিয়েছে। উপজেলা শহর হতে প্রায় ২০রুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সে কারনে চরবাসি পায়েঁ হেটে চলাচল করছে। বেকার হয়ে পড়েছে জেলে ও নৌ-শ্রমিকরা। নদী খনন ও ড্রেজিং এখন সময়ের দাবি।
উপজেলা নিবার্হী অফিসার মো. তরিকুল ইসলাম জানান, উজানের ঢলে পলি জমে তিস্তা নদীটি ভরাট হয়ে গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে কারনে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। নদীটি খনন ও ড্রেজিং করলে নৌ- চলাচল সম্ভব এবং উপজেলা অনেকটা নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, নদী ড্রেজিং, খনন ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা সরকারের উপর মহলের সিদ্ধানের ব্যাপার। তবে নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়াম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক আশরাফুল আলম সরকার জানান, তিনি নিজেও নদী পাড়ের মানুষ। তাঁর বাড়িও কয়েক দফা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিস্তা নদী সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে খনন ও ড্রেজিং করা হয়নি। সে কারনে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নদী খনন ও ড্রেজিং করার দাবি তাঁর।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ নাহিদ নিগার জানান, সংসদের প্রথম অধিবেশনে নদী ভাঙন নিয়ে কথা বলেছি। তবে নদী ভাঙন রোধসহ বিভিন্ন রুটে নৌ-চলাচল চালু করতে গেলে নদী খনন ও ড্রেজিং এবং সংরক্ষণের বিকল্প নেই।