ভবতোষ রায় মনা ►
দেশজুড়ে বইছে তীব্র দাবদাহ। গাইবান্ধাতেও তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। অস্বস্তিকর গরমের মধ্যেই শুরু হয়েছে দফায় দফায় লোডশেডিং। দুপুর, সন্ধ্যা, গভীর রাত কিংবা ভোর কোনো নিয়মই মানছে না বিদ্যুতের লুকোচুরি। সেই সাথে যোগ হয়েছে মশার উৎপাত। সব মিলিয়ে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে সময় কাটাচ্ছে গাইবান্ধার মানুষ। তারপরেও সামান্য প্রশান্তির খোঁজে মানুষ ছুটছেন গাছের ছায়ায়, ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানগুলোতে।
এ জেলায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টির কোন দেখা নেই। সেই সাথে গত ৩/৪ দিন ধরে তীব্র তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। সাথে রয়েছে বিদ্যুৎতের ভেলকিবাজি। গত কয়েকদিন ধরে ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রা বিরাজ করছে জেলা জুড়ে। রংপুর আবহাওয়া অফিস সুত্রে জানায়, আজ সোমবার সকাল ১০টায় গাইবান্ধায় ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সূর্যের প্রখর তাপে সাধারণ মানুষের জীবন পুরোপুরিভাবে বিপর্যয় হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি না হওয়া আর প্রচন্ড রোদে ঘর থেকে বের হতে পারছেনা শ্রমিক, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। সামান্য স্বস্তি ও একটু শীতল পরিবেশের জন্য সবাই ছুটছে গাছের ছায়াতলে। অতিরিক্ত গরমে শিশুরা ছুটছে বিভিন্ন শরবত ও পানীয়ের দোকানে। কোথাও কোথাও পুকুরে নেমে পড়ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। পৌর পার্কের পুকুরে একদল কিশোর গরম থেকে বাচঁতে পানিতে নেমে লাফালাফি করতে দেখা গেছে। অনেকেই আবার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ও বসে আছে।
তীব্র গরমের মধ্যে বাতাসে আর্দ্রতা কমে গেছে। রাস্তায় বের হলে আগুনের হল্কা এসে গায়ে লাগছে। অতিরিক্ত গরমের কারনে প্রয়োজন ছাড়া দিনের বেলা কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। অবশ্য রাতে ঘরে ফিরেও স্বস্তিতে থাকার উপায় নেই। দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে রাতেও ঘেমে ভিজে নাকাল হচ্ছে মানুষ।
গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা সিজু মন্ডল জানান, আজ (সোমবার) সকালেও বিদ্যুত ছিলো না। তিনি বলেন, প্রচন্ড গরমে ফ্যান চালিয়েও ঘরে থাকা যায় না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকলে মনে হয় ‘ভয়ঙ্কর আজাব’ শুরু হলো। মশার যন্ত্রণায় বাইরে বসে থাকারও উপায় নেই। এই কষ্ট বলে বোঝাতে পারবো না।
রিকশাচালক মো. মাইনুর মিয়া বলেন, সূর্যের অনেক তাপ। রোদে সারা শরীর পুড়ে যায়। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত আর বিকালে ৫টার পর থেকে গরম কিছুটা কম থাকে। সকাল ১০টার পর থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রচ- তাপদাহ থাকে। মনে হয় যেন চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। শরীর ঘেমে যায়। শরীর দূর্বল হয়ে আসে। রিক্সা চালাতে অনেক কষ্ট হয়।
শহরের পলাশ পাড়া এলাকার বাসিন্দা গাজী আরমান বলেন, বাতাসে যেন আগুন উড়ছে। প্রচ- গরম। গরমের সাথে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এই গরমে বাইরে যেমন বের হওয়া যাচ্ছে না, তেমনই ঘরেও অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে।
সরেজমিনে সোমবার গাইবান্ধা জেলা শহরের শিল্পকলা একাডেমির সামনে, পুরাতন ব্রিজ,নতুন বাজার, পূর্বপাড়া, হকার্স মার্কেট, আসাদুজ্জামান স্কুলের সামনেসহ বিভিন্ন মোড়ে ভ্যানগাড়িতে করে তালের শাঁস বিক্রি করতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে দেখা গেছে ক্রেতাদের বেশ চাহিদা। আবার শহরের পৌরপার্ক, ডিসি অফিস, কাচারি বাজার, জেলা পরিষদ চত্বর, ট্রাফিক মোড়, ডিবি রোড, রেল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকান বসেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শরবত। জেলার সাত উপজেলায় শতাধিক ভাসমান শরবতের দোকান রয়েছে।
পূর্বপাড়া এলাকায় তালশাঁস বিক্রেতা আব্দুর রহিম মিয়া (৪৪) বলেন, তাল যখন কাঁচা থাকে, তখন বাজারে এটা পানি তাল বা তালের শাঁস। হিসেবেই বিক্রি হয়। প্রতিটি কাঁচা তাল ১০ থেকে ২০ টাকা ও তালের শাঁস প্রতিটি ৫ টাকা পিস বিক্রি হয়।
শরবত বিক্রেতারা জানান, মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে চিনি, লেবু, তোকমা, ইসবগুলের ভুসি, শাহিদানা, অ্যালোভেরা ও উলটকমল দিয়ে শরবত তৈরি করা হয়। এসব শরবতের অনেক চাহিদা রয়েছে। তীব্র গরমে এ শরবতের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রত্যেক শরবতওয়ালা দিনে প্রায় ১৫০-২০০ গ্লাস শরবত বিক্রি করেন।
শরবত খেতে আসা রিকশাচালক আজাহার আলী বলেন, সারাদিন রিকশা চালাই। শরীরকে ভালো রাখার জন্য ফলের শরবতের ওপর কিছু আছে বলে মনে করি না। তাই যখনই ক্লান্ত হই, তখনেই ফুটপাতের এসব দোকানে এসে শরবত পান করি। জান্নাতি ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী জানায়, স্কুল ছুটি হলেই লেবুর শরবত পান করি। তীব্র গরমে লেবুর শরবত শরীরে অন্যরকম আমেজ নিয়ে আসে। এক গ্লাস পান করলেই প্রশান্তি পাই।
গাইবান্ধা শহরের ঘোল বিক্রেতা সুনীল ঘোষ বলেন, তীব্র গরমে ঘোলের চাহিদা অনেক বেড়েছে। তবে শীতকালে কমে যাবে। প্রতিদিন ৯০-১৩০ গ্লাস ঘোল বিক্রি হয়। রিকশাচালক, শ্রমিক ও পথচারীরা বেশি ঘোল পান করেন। প্রতি গ্লাস ঘোল ১০ টাকায় বিক্রি করছি। এতে পরিবারের লোকজন নিয়ে ভালোই আছি।
বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা লিমন মিয়া বলেন, কর্মব্যস্ততা শেষ করে যে বাসায় ফিরে কোথায় স্বস্তিতে থাকব, সেখানে দিনে ও মধ্যরাতে ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এই গরমে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, গরমে পানি স্বল্পতাসহ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। তাই তীব্র তাপদাহে শিশু, বৃদ্ধ ও রোজাদারদের খুব জরুরি কাজ ছাড়া বাহির বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।