• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১-৫-২০২৪, সময়ঃ সকাল ১০:৩১

শ্রমিকের কল্যাণে আসছে না গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র



কায়সার রহমান রোমেল, গাইবান্ধা

উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় প্রায় ৫৮ বছর আগে শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা, প্রশিক্ষণ ও বিনোদনের জন্য গড়ে তোলা হয় শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র। জেলা শহরের গোডাউন রোডে ২০২১ সালে প্রায় ২ একর জায়গায় নতুন করে নির্মাণ করা হয় তিনতলা আধুনিক ভবন। এই কেন্দ্র শ্রমিকদের কল্যাণে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গড়ে উঠলেও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে প্রায় অকার্যকর-অব্যবহৃত রয়েছে। অথচ প্রতিবছর এ কেন্দ্রের জন্য চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন বাবদ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে যাঁদের জন্য আয়োজন, তাঁরাই গরহাজির! শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্য চিকিৎসা সেবা, প্রশিক্ষণ, বিনোদনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গাইবান্ধায় শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে শ্রমিক-স্বার্থে এসব সেবার খবরই রাখেনা শ্রমিকেরা। তারা জানেন না এখানে কী হয়। মুলত: প্রচার-প্রচারণার অভাবে অনেক শ্রমিকই জানেন না শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের খবর ও এখানকার প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও সেবার বিষয়টি। ফলে শ্রমিকদের কোনো কল্যাণে আসছে না গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটি। সরকারি শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের সেবা ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে শ্রমিক অধিকার এবং সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কল্যাণ কেন্দ্রটিকে সচল রাখার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।

গাইবান্ধায় নিবন্ধিত শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় ১২৯টি। এছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই রয়েছে একটি করে শ্রমিক সংগঠন। জেলায় শ্রমিক ইউনিয়ন আর শ্রমিক সংগঠনের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত জেলার শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটিকে সক্রিয় করে এর সেবাসমূহ শ্রমিকদের কাছে পৌছে দেয়ার উদ্যোগ, শ্রম অধিকার সুরক্ষায় শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দর কষাকষি ক্ষমতারও নেই প্রয়োগ। বছরজুড়ে নিশ্চুপ থাকলেও শুধু মে দিবসেই রেওয়াজ মেনে র‌্যালি-শোভাযাত্রা আর সভা-সমাবেশেই যেন নিয়মরক্ষায় সরব হয়ে ওঠা বেশিরভাগ শ্রমিক সংগঠনগুলোর।

গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এই কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা, শ্রমকল্যাণ সংগঠক, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ফার্মাসিস্ট, ডিসপেন্সারি এ্যাটেনডেন্ট, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, অফিস সহায়ক, আয়া, নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ ১২টি পদে জনবল রয়েছে। এই শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে প্রধান দুটি পদ মেডিকেল অফিসার এবং জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার ২টি পদ ২০২২ সাল থেকে শূন্য রয়েছে। এছাড়া শ্রমকল্যাণ সংগঠক, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ডিসপেন্সারি এ্যাটেনডেন্টসহ আরও ৩টি গুরুত্বপুর্ন পদ শূন্য রয়েছে। এ অবস্থায় বন্ধ রয়েছে কল্যাণ কেন্দ্রটির চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম। পরিবার-পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়ে ফার্মাসিস্ট করছেন পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার কাজ। ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও এখানে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন।

মঙ্গলবার (৩০ মে) সরেজমিন গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, অব্যবহৃত পড়ে আছে তিনতলা ভবনটির নিচতলার একপাশে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র অন্যপাশে পরিবার-পরিকল্পনা সেবা কেন্দ্র। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্রশিক্ষণ কক্ষ, বিনোদন কক্ষ, লাইব্রেরি, দর্শনার্থী কক্ষ, বিশ্রামাগার এবং তৃতীয় তলায় কনফারেন্স রুম আর অফিস কক্ষ। ভবনজুড়ে সুনশান নিরবতা। নেই শ্রমিক অথবা শ্রমিক পরিবারের আনাগোনা। কেন্দ্রে সেবা কার্যক্রমগুলো চালু না থাকায় এখানে শ্রমিক আসছে না। ফলে কর্মরতরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

রিক্সাচালক ছক্কু মিয়া গাইবান্ধা পৌর শহরে ৪৫ বছর থেকে রিক্সা চালান। তিনি বলেন, এই রাস্তা দিয়ে রোজ রিকশা চালান। এখানে এই ভবনটিকে লেবার অফিস নামেই চেনেন তিনি। তবে এখানে শ্রমিকদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেটাই জানেন না তিনি।

গাইবান্ধা জেলা পরিবহন সুপারভাইজার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান বাবু বলেন, আমাদের সাথে শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটির কোন যোগসূত্রই তৈরি হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনেছি। আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না তারা, আমরাও নেইনি তাদের খোঁজ। বেশিরভাগ শ্রমিকই জানে না শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটি কোথায়।

গাইবান্ধা কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি ও জাতীয় শ্রমিক পার্টির জেলা সভাপতি শ্রমিক নেতা রেজাউন্নবী রাজু বলেন, শুধুমাত্র জনবল না থাকায় সেবা প্রদানে ব্যর্থ সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর হয়ে আছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটি পুরোদমে চালু রাখার একাধিক প্রতিশ্রুতি এলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর শ্রমিকরাও বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের অধিকার থেকে। অথচ সরকারকে প্রতি বছর এই কেন্দ্রে কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মেটাতে গিয়ে ব্যয় করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটি মাঝে মধ্যে কিছু শ্রমিককে নিয়ে সেমিনার করে যা লোক দেখানো। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক-গবেষক অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন, যাটের দশক থেকে গাইবান্ধার শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রটি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলো। এখানে একসময় শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসাসেবা নিতেন। নিয়মিত চিকিৎসক বসতেন, ব্যবস্থাপত্র দিতেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রনুযায়ী শ্রমিকরা প্রয়োজনীয় ওষুধও পেতেন। বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির চত্বরে শ্রমিকরা বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহন করতেন। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মেডিক্যাল অফিসারসহ পাঁচটি গুরুত্বপুর্ণ পদে জনবল না থাকায় শ্রমিকদের সেবা দিতে পারছে না কেন্দ্রটি। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগ নিবেন আশাকরি।

গাইবান্ধা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ও শ্রম কল্যাণ সংগঠক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ পাঁচটি পদে জনবল না থাকার বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এসব সমস্যার সমাধান শিগগির হবে।