• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১৭-১২-২০২২, সময়ঃ সকাল ১০:৪৮

রাণীনগরে সর্ব রোগের চিকিৎসা দেন মাট্রিক পাসের ডাক্তার জজ ॥ ভুল চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই হয়েছেন পঙ্গু



আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ  ►

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউনিয়নের ভাটকৈ বাজারে বছরের পর বছর এসএসসি পাস করে সকল রোগের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন চিকিৎসক শরিফুল ইসলাম জজ। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চিকিৎসা প্রদান করে আসছেন জজ ডাক্তার নামে পরিচিত এই চিকিৎসক। তার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার পর বর্তমানে অনেকেই পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

সূত্রে জানা গেছে, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, প্যারালাইজ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, নাক-কান-গলা, বাতের ব্যথাসহ যে কোন ব্যথাসহ সকল রোগের চিকিৎসা প্রদান করে আসছেন চিকিৎসক জজ। তিনি শুধু রোগী দেখে কোন প্রকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হাই-পাওয়ারের অ্যান্টবায়েটিক ব্যথার ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। এতে করে গ্রামগঞ্জের নিরীহ মানুষগুলো তাৎক্ষণিক ব্যথার ইনজেকশনে আরাম পেয়ে যান। যার কারণে জজ ডাক্তারের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু না বুঝেই সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই এই হাতুড়ে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই স্থায়ী ভাবে পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের রোগীরা এসে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন জজ ডাক্তারের। প্রতিদিন তার কুঁড়ে ঘরের মতো ঔষধের দোকানে প্রত্যন্ত এলাকার শত শত রোগীরা এসে লাইন ধরে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। তাৎক্ষণিক ভাবে জজ ডাক্তার রোগীদের দেখে একটি নামবিহীন সাদা কাগজের প্যাডে ঔষধের নাম লিখে দিচ্ছেন আর ওই ঔষধগুলো তার দোকান ছাড়া অন্য দোকানেও মিলে না। বিভিন্ন বেনামী কোম্পানির সঙ্গে আতাত করে নিম্ম মানের ঔষধগুলো বিক্রি করে নিরীহ মানুষগুলোকে ঠকিয়ে যেমন হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ তেমনি ভাবে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষগুলোকে ঠেলে দিচ্ছেন স্থায়ী ক্ষতির দিকে। বর্তমানে জজ ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রহণের কিছুদিন পরে অনেকে পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে বিছানাতে শুয়ে রয়েছেন। এদের মধ্যে যাদের অর্থ আছে তারা অন্যত্র উন্নতমানের চিকিৎসা নিচ্ছেন আর যাদের অর্থ নেই তারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। জজ ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা নিয়ে অনেকেরই হাত কিংবা পা কেটে ফেলতে হয়েছে এমনটি অভিযোগও রয়েছে অনেক।

উপজেলার সিংগাহার গ্রামের আলহাজ্ব রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি খেলতে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ওই পল্লী চিকিৎসক জজের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে যাই। প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে সরাসরি একটি সাদা শিশি থেকে ব্যথা নিবারনের ইনজেকশন পুশ করেন। এরপরে কয়েকদিন ভালো ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই পাফুলে ওঠে। এরপরে নওগাঁ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে চিকিৎসক রাজশাহী মেডিকেলে রেফার্ড করেন। পরে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দীর্ঘ ৯মাস চিকিৎসা গ্রহণের পর ঘরে ফিরতে পেরেছি। তবুও এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। পল্লী চিকিৎসক জজের ভুল ইনজেকশনের কারণে আমি স্থায়ী ভাবে মারাত্মক তিগ্রস্থ হয়েছি।

উপজেলার শফিকপুর গ্রামের মৃত আজিম সরদারের ছেলে আফজাল সরদার বলেন, কিছুদিন পূর্বে আমার হাঁটুতে সামান্য ব্যথা শুরু হয়। আমি দিনমজুর মানুষ। কাজ করতে গিয়ে হাঁটুতে একটু ব্যথা পাই এবং ভাটকৈ বাজারের ডাক্তার জজ এর কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে ৩শত টাকা নিয়ে আমাকে হাঁটুর গিড়াতে একটি ইনজেকশন করেন। পরপর ৮মাসে ৮টি ইনজেকশন করেন ডাক্তার জজ। এখন আমি আর হাঁট চলা করতে পারি না। কোনো মতে লাঠি ধরে চলা ফিরা করি। ৮মাসে ডাক্তার জজকে ৪থেকে ৫হাজার টাকা দিয়েছি। ডাক্তার জজ এর কাছে চিকিৎসা নিয়ে এখন আমি পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বাজারের অনেক পল্লী চিকিৎসকরা বলেন, পল্লী চিকিৎসকদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা। কিন্তু জজ ডাক্তার ব্যথানাশকের ইনজেকশনগুলো কোন ডিগ্রিধারী বিশেজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ ছাড়াই কিভাবে প্রদান করেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা দেখেছি জজ ডাক্তার এমন কোন রোগ নেই যার চিকিৎসা সেবা তিনি প্রদান করেন না। এতে করে সাময়িক আরামের জন্য না জেনে না বুঝে ভুল চিকিৎসা গ্রহণের কারণে নিরীহ মানুষগুলো ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। অনেক মানুষ জজ ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে এখন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। জজ ডাক্তার একা রোগীর চাপ সামলাতে পারেন না বলে তিনি আরেক অনভিজ্ঞ সহকারি রেখেছেন তার চেম্বারে। আবার অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা এসে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাত করে যান। এরপর তারা কি করেন তা আমরা জানি না। তবে দ্রুত জজ ডাক্তারে এই দৌরাত্ম বন্ধ করতে না পারলে হাজার হাজার মানুষ এক সময় পঙ্গু হয়ে যাবে।  

পল্লী চিকিৎসক শরিফুল ইসলাম জজ বলেন, আমি এসএসসি পাশ করেছি কিন্তু এইচএসসি পাশ করতে পারিনি। এরপর থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাটকৈ বাজারে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। অনেক জটিল জটিল রোগ আমি চিকিৎসা দিয়ে ভালো করছি। যার কারণে অনেক দূরদুরান্তের মানুষরা আমার কাছে চিকিৎসা নিতে ছুটে আসেন। লুঙ্গি পড়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন যে তিনি রোগীদের চাপে অন্য পোষাক পড়ার সময় পান না। তিনি চিকিৎসা বিষয়ে কোন উন্নত প্রশিক্ষন নিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে কিংবা কোন সনদপত্র দেখাতে পারেননি জজ ডাক্তার। 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কেএইচএম ইফতেখারুল আলম খাঁন বলেন, আমি এই ডাক্তার সম্পর্কে শুনেছি। সরকারি রেজিস্টার্ড ভুক্ত চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ব্যথার ইনজেকশন প্রদান করতে পারেন না। আর পল্লী চিকিৎসকরা শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান পূর্বক ঔষুধ বিক্রয় করতে পারেন। তবে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে ওই চিকিৎকের খোজ-খবর নিয়ে আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন অতি দ্রুতই চিকিৎসা বিভাগের কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে জজ নামক ওই চিকিৎসকের চিকিৎসালয় পরিদর্শন করবো। জজ ডাক্তার যদি নিয়ম বর্হিভ’ত চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।