• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১৩-৮-২০২৩, সময়ঃ সকাল ১০:৩৭

ফুলছড়িতে জমির ভাড়া বাবদ রেলের কাছে কৃষকদের পাওনা ৬ কোটি টাকা



ভবতোষ রায় মনা ►

বিগত ১৩ বছরে রেলের কাছে জমির ভাড়া বাবদ ফুলছড়ি উপজেলার ছয় শতাধিক কৃষকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। ১৯৯৬-৯৭ সালে ৬২৯ জন কৃষকের কাছ থেকে ভাড়া পরিশোধের শর্তে ১৪৫ দশমিক ৭৩ একর জমি অস্থায়ী হুকুম দখল করে স্থাপন করা হয় ত্রিমোহিনী স্টেশন থেকে বালাসী পর্যন্ত নতুন সাড়ে ৮ কিলোমিটার রেলপথ। এরপর প্রথম ১৩ বছরে ভাড়া বাবদ প্রায় ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও গত ১৩ বছর ধরে ভাড়া বকেয়া রেখেছে রেল বিভাগ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ এলাকায় যমুনা নদীতে রেল ফেরি চালু করে। ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে যমুনার নাব্য সংকটে ফেরি সার্ভিসটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে উপজেলার কঞ্চিপাড়ার বালাসীঘাটে স্থানান্তর করা হয়। ত্রিমোহিনী থেকে বালাসী পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে ফুলছড়ি উপজেলার বালাসিঘাট পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করতেন এই অঞ্চলের মানুষজন। এছাড়াও সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া হয়েও ট্রেনেই এই ঘাট দিয়ে মানুষ চলাচল করতেন। তবে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর থেকে লোকাল ট্রেন, মেইল ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কিছুদিন মালবাহী ওয়াগনবাহী ট্রেন চালু থাকলেও পরে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

২০০৯-১০ সালের দিকে আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে রেলওয়ে ফেরির সাথে বন্ধ হয় রেল চলাচলও। এরপর রেল অপসারন না করে জমি ফেলে রেখে ভাড়ার বোঝা টানছে রেল কর্তৃপক্ষ। এদিকে পাওনা আদায়ের জন্য প্রশাসন ও রেল কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জমির মালিকরা প্রায় ক্লান্ত। 

বালাসীঘাট এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, আমাদের যে পরিমাণ জমি রেল অধিগ্রহন করেছে তাতে আমরা দেড় লাখ টাকা পাবো। কিছুদিন আগে রেল কৃর্তপক্ষ রেললাইন অপসারণ করাসহ পাওনা টাকা পরিশোধের কথা ছিলো। কিন্তু সে কথা তারা রাখেনি।

আরেক কৃষক মাহবুবর রহমান জানান, আমার ২ একর ২ শতক জমি রেল অধিগ্রহণ করেছে। ভাড়া বাবদ এ পর্যন্ত ৭ লাখ টাকা রেলের কাছে পাবো। কিছুদিন আগে রেল কৃর্তপক্ষ রেললাইন অপসারণ করাসহ পাওনা টাকা পরিশোধের কথা ছিলো। কিন্তু সে কথা তারা রাখেনি।

ফুলছড়ি উপজেলার হরিপুর গ্রামের সাহিম রেজা জানান, বাপ-দাদার ৭ বিঘা আবাদি জমি রেল অধিগ্রহণ করেছে। জমিতে ফসলের মূল্যেমান নির্ধারণ করে রেল কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধ করে। সে হিসেবে কমপক্ষে প্রায় দেড় লাখ টাকার মত পাবো। তারা টাকাও দিচ্ছে না, জমিও ছাড়ছে না। তিনি আরও বলেন, জমির ভাড়া বাবদ টাকা পরিশোধসহ চাষাবাদযোগ্য জমি ফেরত দিতে হবে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট থেকে সদর উপজেলার ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার রেলপথের দুর্দশা। রেললাইনের উপর গড়ে উঠেছে শত শত বসতবাড়ি। মাটি সরে কোথাও আবার ঝুলে আছে রেল। নাট-বল্টু ও স্লিপারের মতো মূল্যবান যন্ত্রাংশের হদিস নেই অনেক জায়গায়। গোটা রেলপথ জুড়ে চোখে পড়লো না একটি পাথরও।

আরো অনেক আগে থেকে বন্ধ তিস্তামুখ ঘাট থেকে বোনারপাড়া রুটে ট্রেন চলাচল। অলস পড়ে থাকায় এই পথেও জরাজীর্ন হয়ে নষ্ট হচ্ছে রেলসহ মূল্যবান সম্পদ। কালের স্বাক্ষী হয়ে টিকে থাকলেও ভরতখালী স্টেশনে আর ট্রেন থামেনা, নেই যাত্রীদের কোন হাক ডাক। সুযোগ বুঝে রেলের জায়গা জমি বেহাত করছে কেউ কেউ। রেলের বন্ধ রুট দু’টিতে প্রায় ১৭ কিলোমিটার রেলপথে কমপক্ষে একশো কোটি টাকার সরকারী সম্পদ পড়ে আছে।

ভরতখালী রেলস্টেশন এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, রেললাইনেতো পাথর নেই। স্লিপার পঁচে গেছে, রাতের আধারে চুরি হচ্ছে রেলপাতসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। সরকারি সম্পদ এইভাবে নষ্ট হচ্ছে, অথচ দেখার কেউ নেই।

তিস্তামুখ থেকে ফেরিঘাট বালাসীতে স্থানান্তরের পর বেশি দিন চালু থাকেনি। বালাসী ও বাহাদুরাবাদ রেল ফেরি যে বন্ধ আছে তাও এক যুগের অধিক হয়ে গেছে। ফলে এরুটের মূল্যবান জিনিসপত্র বেহাত হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন এম এম কিন্ডার গার্টেনের পরিচালক আতিকুর রহমান।

জেলা প্রশাসন সুত্র জানায়, বারবার তাগিদ দিয়েও জমি ভাড়ার বকেয়া টাকা পরিশোধে আগ্রহ দেখায়নি রেল বিভাগ। তবে পরিত্যক্ত রেল অপসারন আর জমি ভাড়া বাবদ বকেয়া পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে দাবী কর্তৃপক্ষের।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজশাহীর মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, তিস্তামুখ ও বালাসীঘাট রেল রুট বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমরা যদি রেললাইন অপসারণ করি তাহলে জায়গাগুলো দখল হয়ে যাবে। জমি সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে অচিরেই আমাদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হবে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজশাহীর প্রধান প্রকৌশলী (পশ্চিম) মো. আসাদুল হক জানান, ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত যে টাকাটা তারা পায়, সেটা বাজেট দেওয়া হয়েছে। এক দুই মাসের মধ্যে রেল অপসারণ করা হবে বলে তিনি জানান।

এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধে আগ্রহী হলেও ২০২৩ সাল পর্যন্ত জমির ভাড়া পরিশোধের পর রেল অপসারণ করে জমি ফেরত চায় কৃষককেরা।

তিস্তামুখ ঘাট থেকে বোনারপাড়া আর বালাসীঘাট থেকে ত্রিমোহিনী, এই রেলপথ দু’টি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অকেজো অবস্থায়। এতে অপচয়ের খাতা যেমন দীর্ঘ হচ্ছে, আরেকদিকে চোখের সামনেই বিনষ্ট হচ্ছে রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ।