• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১১-১২-২০২২, সময়ঃ সকাল ০৯:১৩

পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পরেই ঝড়ে পড়ছে চরের শিক্ষার্থীরা



ভবতোষ রায় মনা ►

কাবিলপুর চর থেকে নদীপার হয়ে একা একা স্কুলে যেতে ভয় লাগে। মমেনা খাতুন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো। আঁকাবাকা ফাঁকা রাস্তায় কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটবে এই ভয়ে এক বছর পড়ার পর যাতায়াত সমস্যার কারণে আর স্কুলমুখো হয়নি। মমেনা বলেন, তার স্কুলজীবনের সঙ্গী হাসনা, রেখা ও তাহেরা ৫ম শ্রেণি পাশ করার পর কেউ আর স্কুলে যায় না। আমার ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করে অনেক বড় হবো, কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।

শুধু মমেনা খাতুন নয়, গজারিয়া ইউনিয়নের চর কটকগাছা গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আয়নাল মিয়া বলেন, হামরা গরিব মানুষ। বাহিরে নেখা পড়া করাইতে অতো ট্যাকা কই পাবো বাবা। পড়াশুনার খরচা, নাও ভারা দেওন নাগে। নদী পার হতে যাইয়া কখন কী হয়। এ কারণে বাবা কইচে তোর পড়ার দরকার নাই। মমেনা ও আয়নালের মত চরে মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পরেই ঝরে পড়ছে বেশির ভাগ শিশু। এদের মধ্যে ছেলেরা নিয়োজিত হচ্ছে কৃষিকাজে আর মেয়েদেরকে বসতে হচ্ছে বাল্যবিবাহের পিড়িতে। 

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়ন ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ী, ফুলছড়ি। এছাড়া কঞ্চিপাড়া, উড়িয়া, উদাখালী ও গজারিয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা চরাঞ্চলে হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরাও উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব ইউনিয়নের বিশাল জনগোষ্ঠী কেবল শিক্ষাই নয়, বঞ্চিত সব রকমের সুযোগ-সুবিধা থেকে।

ফলে প্রাথমিকের গন্ডি পেরোতেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থাকলেও ঝরে পড়ছে অকালে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। আবার অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে বাল্যবিবাহসহ শিশুশ্রমে। এদিকে যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে, তার একটি তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। 

জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনায় জেগে ওঠা ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১৬৫টি চর-দ্বীপচর রয়েছে। এসব চরে বসবাস করে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তাদের একমাত্র প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষি। কৃষির ওপর নির্ভর করেই তারা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকেন। 

সরকারি পরিসংখ্যানে গাইবান্ধা জেলায় সারতার হার ৬৬ ভাগ। ফুলছড়ির চরাঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪টি ও দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে মাত্র ২টি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এর তথ্য অনুযায়ী ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চরাঞ্চল থেকে ৮০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাথমিকের গন্ডি পাস করলেও অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভর্তি হতে পারেন না। চরাঞ্চলের শিক্ষার নিম্ন হারের কারণে জেলায় বাড়ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। এই চরাঞ্চলগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনের দাবি অবিভাবকদের।

উপজেলার কাবিলপুর চরের বাসিন্দা জুনাইদ সিদ্দিকি পড়েন গাইবান্ধা সরকারি কলেজে। সিদ্দিক জানান, ওই চর থেকে গত বছর ২৩ জন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেও হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে মাত্র ৭ জন। চর এলাকায় হাই স্কুল না থাকাই ঝরে পড়ার মূল কারণ। মূল ভূখন্ড উপজেলা কিংবা জেলা শহরে পড়তে হলে অনেক দূরের পথ অতিক্রম করতে হয়। অনেকেই হাই স্কুলে ভর্তি হলেও মাঝপথে ঝরে পড়ে যাতায়াত ও আবাসন সংকটের কারণে।

চর কাবিলপুর গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল হাসান বলেন, পড়তেতো ইচ্ছে করে, কিন্তু হামঘরে (আমাদের) চরে বড় স্কুল নাই। তাই বাবা কইচে আর পড়তে হবে না। তুই হামার সঙ্গে খেতোত (জমিত) কাজ করবি। তখন থ্যাকা বাধ্য হয়ে বাবার সাথে কৃষিকাজ করি। 

কালাসোনা চরের তিন সন্তানের জনক হবিবুর রহমান (৬০)। তিনি জানান, হামার দুই পোলা আলাল ও দুলাল। ওরা দু‘জনেই ৫ কাস পাস করিসে। ওর উপরে আরও কোন স্কুল চরে না থাকায় দুই পোলা স্কুলে যাইতে পারে নাই। ওরা এখন কৃষি কাজে যুক্ত হয়েছে। আর মাইয়া হাবিবা খাতুন বাড়ির কাছে স্কুল থাকায় সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেহা করছে। তিনি আরও জানান, হাতের উপর সংসার, ওদের যদি বড় স্কুলে ভর্তি করায়, তাহলে নদী পার হতে হবে, নৌকা ভাড়া লাগবে, দুপুরে খাওন দিতে হইবো। মেলা খরচা হবো, আমি একা কিভাবে সামলামু। 

এ প্রসঙ্গে মানবাধীকার কর্মী আব্দুল কাদের ভূইয়া আকাশ জানান, দুর্গম চরে যাতায়াত সমস্যা প্রকট। মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ নেই। যেহেতু চরগুলো প্রায় নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সেক্ষেত্রে দুই তিনটি চরে মিলে ন্যূনতম একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলে ওইসব এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের অকালে ঝড়ে পড়া থেকে রক্ষা হতো। 

শিক্ষাবিদ জহুরুল কাউয়ুম বলেন, চরাঞ্চলে পর্যাপ্ত মাধ্যমিক স্কুল না থাকার কারণে কিন্ত এমনটি ঘটছে। দুই তিনটি চর এলাকার সাথে সমন্বয়ে মাধ্যমিক স্কুল গড়ে তোলা হলে চরে উন্মোচিত হতে পারে শিক্ষার নতুন দিগন্ত। তখন চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সুযোগ পেয়ে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও অপরাধের মত কর্মকা- থেকে বিরত থাকবে। পাশাপাশি বাড়তো জেলায় শিক্ষার হার।

ফুলছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক  শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ মনিরুজ্জামান জানান, উপজেলার চরাঞ্চলের এরেন্ডবাড়ী ইউনিয়নে হরিচন্ডী ও জিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় এবং আলগারচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া উড়িয়া ইউনিয়নে চিকির পটল দাখিল মাদ্রাসা এবং ফুলছড়ি ইউনিয়নে ফুলছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও টেংরাকান্দি এমএ সবুর দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। ফজলুপুর ইউনিয়নের কোন মাধ্যমিক কিংবা মাদ্রাসা নেই।

এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, ‘চরাঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যে কয়টি বিদ্যালয় আছে তা নদী তীর ঘেষে। আর যে চরগুলোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উপযোগী, সেই চরগুলোর একটা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তালিকাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্ততি চলছে বলে জানান তিনি।