- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ২৪-১২-২০২৩, সময়ঃ সন্ধ্যা ০৬:১৬
চরাঞ্চলে বাড়ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা
এ মান্নান আকন্দ, সুন্দরগঞ্জ►
গামছা দিয়ে প্যাচানো ভাতের গামলা মাথায়, হাতে পানির জগ ও মগ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন খেয়াঘাটের যান ফুলমতি। তখন সকাল ১০ বা সাড়ে ১০ বাজে। প্রায় দিনেই ফুলমতির সাথে থাকেন জোনাকি, নয়ামতি, হাফিজা, কাকলি ও আয়শা। সবার বয়স প্রায় ৮ থেকে ৯ বছর। খেয়াঘাটের মাঝি সোবহান মিয়ার সকালের খাবার নিয়ে যান শিশু কন্যা ফুলমতি আর ওরা সহপাঠি। এ সময় ওদের স্কুলে থাকার কথা। কিন্তু ওরা স্কুলের বাইরে কেন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চমৎকার সব তথ্য।
২০২২ সালের জুন মাস থেকে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে আর বিস্কুট দেয় না ডব্লিউএফপি। দূর্গম চরের স্কুলগুলোতে ক্লাস শুরু হয় সকাল ১১ টার পর। প্রতিদিন স্কুলে আসেন না সকল শিক্ষক। মাসে অর্ধেক দিন স্কুলে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন নেন অনেকে। সে কারনে নিম্নমুখি হচ্ছে শিক্ষারমান ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ২৫৯টি। এর মধ্যে ১৪০টি সরকারি ও ১১৯টি নব সরকারি। উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। তিস্তার চরাঞ্চলে ৩৮টি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। এরমধ্যে নবসৃষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২টি,সরকারি ৩৬টি। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত বেশ কয়েকটি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে।
উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের দূর্গম চরের পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোচাগাড়ি নব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর কাপাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাটি কাপাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উজান বুড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাটি বুড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ২০২২ সালে মোট ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৭৪ জন এবং গড় উপস্থিতি ছিল ৮৫-৯০ ভাগ। ২০২৩ সালে ওই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে মোট ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪৮ জন এবং গড় উপস্থিতি ৪০-৪৫ ভাগ। প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ জানান, বিস্কুট বিতরণ বন্ধ হওয়ায় ভর্তি এবং উপস্থিতির হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। স্থানীয় দাবি কাগজ-কলমে এসব তথ্য থাকলেও প্রকৃত পক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কম।
দূর্গম চরের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা সাড়ে ১১ থেকে ১২টা ছাড়া স্কুলে আসেন না, জানালেন কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার গ্রামের রফিকুল ইসলাম। তাও আবার প্রতিদিন আসেন না। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন আসেন মাঝে মাঝে। কাপাসিয়া ইউনিয়নের অনেক স্কুলের ঘর নেই, এমনকি বেড়াটাটি নাই। কমবেশি প্রতিটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০ থেকে ৬০ জন। বাচ্চারা স্কুলে এসে চলে যায়,তারপর শিক্ষক আসে।
সম্প্রতি সরেজমিন চর কাপাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলে তালা বন্ধ। কোন শিক্ষার্থী,কর্মচারী ও শিক্ষক নেই। তখন ঘড়ির কাটায় ১০.৫ মিনিট। এর ১০মিনিট পর স্কুলে আসে দপ্তরী কাম নৈশ্য প্রহরী তাজুল ইসলাম। সে একায় পতাকা ঝুলায় এবং স্কুলের বিভিন্ন কক্ষের তালা খুলে দেয়। সকাল ১১ টা পর্যন্ত কোন শিক্ষক আসতে দেখা যায়নি স্কুলে। তাজুল বলেন, হেড স্যার অসুস্থ্য ছুটিতে আছে, অন্যান্য শিক্ষকরা নদী পার হয়ে আসতে একটু দেরি হবে।
চর হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক আব্দুর রাজ্জাক মিয়া বলেন, শিক্ষকরা সময়মত স্কুলে না আসার কারনে ছেলে মেয়রা স্কুলে যায় না। তাছাড়া এখন আর স্কুলে বিস্কুট দেয় না, যার জন্য অনেক বাচ্ছা যেতে চায় না।
ভোরের পাখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুর রহমান জানান, উপজেলা শহর থেকে স্কুলটির দুরত্ব ৩৬ কিলোমিটার। তিস্তার মুল স্রোতসহ দুইটি শাখা নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। সে কারনে নিদিষ্ট সময়ে স্কুলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয় না। তবে স্কুলে বিস্কুট বিতরণ বন্ধ হওয়ায় বাচ্ছার উপস্থিতি অনেক কমে গেছে।
কাপাসিয়া ক্লাস্টারের দায়িত্বে থাকা সহকারি শিক্ষা অফিসার আশিকুর রহমান জানান, চরের ৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালযের মধ্যে প্রায় ১৫টি স্কুল দূর্গম চরে। উপজেলা শহর হতে ওইসব স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৩৫ হতে ৪৫ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা একবারেই বিচ্ছিন্ন। তিস্তার তিন থেকে চারটি শাখা নদী নৌকা যোগে পার হয়ে তারপর স্কুলে পৌছতে হয়। যার জন্য শিক্ষকদের পৌছতে একটু দেরি হয়। ডাব্লিউএফপির বিস্কুট বিতরণ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, যে সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।