- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ৬-২-২০২৩, সময়ঃ বিকাল ০৩:০৪
ঘাঘট পাড়ের অহংকারে গাইবান্ধা
প্রণব সাহা ►
করোনার আগেই অনুষ্ঠানগুলো হয়েছিল। ফলে বেশ ক’বছর থেকেই একটা হাহাকারের মধ্যে আছি শৈশব কৈশোর আর তারুণ্যের শহর গাইবান্ধাকে নিয়ে। মধ্যপাড়ায় আমার বাসার কাছেই দু-দুটো হাইস্কুলের বড় দুটি মাঠের মতই আমার হতাশা। কারণ এই দুটি বালক বিদ্যালয়ের বয়স শতবর্ষ পেরিয়েছে। একটু এগুলে গাইবান্ধা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, সেটিও শতবর্ষ প্রাচীন। আর যদি দেবদারু গাছের সারি পেরিয়ে স্কুললেন দিয়ে হেটে আপনি চলে যান পৌরপার্কে তাহলে পাবেন আরেকটি শতবর্ষের প্রতিষ্ঠান গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি এন্ড ক্লাব। পার্কের এপারে পাবলিক লাইব্রেরি আর মাঝের জলাশয়ের উল্টো দিকে গাইবান্ধা পৌরসভা ২০২৩ সালে শতবছরে পা দিবে। ডিবিরোড ধরে এগিয়ে গেলে পাবেন গাইবান্ধা নাট্য সংস্থা, এক সময় ছিল জিসিডিসি। সেও পেরিয়েছে শতবছর। আহা ৬টি শতবর্ষী শিক্ষা-সংস্কৃতি আর নাগরিক সেবার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কোনো অহংকার যখন দেখিনা, তখন হতাশায় নিমজ্জিত হই। সেজন্য করোনা পেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সূচনায় খুব তাগিদ বোধ করছি, একটা কিছু করার। বলা যায় সেই চাওয়াটাকে বাস্তবায়ন করতে গাইবান্ধাবাসী, আর যারা এই শহরের আলোবাতাসে বড় হয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত দেশে-বিদেশে, তাদের কাছে এ আমার এক খোলা দরখাস্ত।
খুব একটা বড় আয়োজন করার পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে বেশ কিছুদিন থেকেই। জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে থাকি। কিন্তু কৈশোর-তারুণ্যের শহর যেখানে শিক্ষার হাতেখড়ি বা সংস্কৃতির মানস গঠন, সেই শহরকে খুব মিছ করি। আর ঐ যে হাতেখড়ির কথা বললাম, সেই মধ্যপাড়া প্রাইমারি স্কুলের বয়সও কিন্তু ৮০বছর। এখন বিরাট গেট হয়েছে, কিন্তু মাঠ ছোটো আর পাশের পুকুরটা হারিয়ে যাওয়ায় পাশ দিয়ে গেলে বুকটা হুহু করে ওঠে। আওয়াজ দিয়েন তারা যারা পড়েছেন এই প্রাইমারি স্কুলে। ডলি আপা, বদি স্যার আর খুরশিদ স্যারকে খুব মনে পড়ে।
একটা শহর যার পাশেই ঘাঘট নদী। দেশের যে প্রান্তই যাই, সবাই খুব জানে গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহি মিষ্টি রসমঞ্জুরীর নাম। প্রশাসনের বেশ কয়েকজনকে কয়েকবার এনে খাওয়াতে হয়েছে, যারা কোনোনা কোনো সময় কাজের সূত্রে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। যখন তাদের সামনেই তুলে ধরি, যে মাত্র দুই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই আছে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুটি সংস্কৃতির একটি শতবর্ষী পৌরসভার কথা সবাই, দারুন উচ্ছ্বসিত হয়। শুধু গাইবান্ধার কাউকে বললে, খুব ধীরে অনুচ্চ কন্ঠে উচ্চারিত হয় “তাই নাকি ?”
তিনটি স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৮৮৫ সালে। ঘাঘটের পাড়ে গাইবান্ধার প্রধান ডাকঘরের কাছে একটি ছোটবাড়িতে স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। বামনডাঙ্গার জমিদার বিদ্যানুরাগী শরৎ চন্দ্র রায় চৌধুরী স্কুলের জন্য ৬ একরেরও বেশি জমি দান করেন। তখনকার রংপুরের ডিসি জেএন দাসগুপ্ত আর গাইবান্ধার এসডিও জেসি দত্ত অন্যান্যদের অর্থ সাহায্যে স্কুলটি গড়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালের ১মে স্কুলটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে স্কুলটি এইচ ই লোকাল ও মডেল স্কুল নামে পরিচিতি ছিল।
২০১৪ সালে স্থাপিত হয়েছিল গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুল। পাশাপাশি দুটো বড় মাঠ আর মাঝ দিয়ে সরু স্কুললেন। চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই স্কুল, কিন্তু কোনো অপ্রীতিকার ঘটনা নেই স্মরণকালের মধ্যে। দেশের খুব কম শহরেই এমনটা আছে। আর এই দুই স্কুলের খুব কাছেই। ইসলামিয়া হাইস্কুল আর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মাঝখানেই মধ্যপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল।
ভাবতেই ভালো লাগে ১০৬ বছর আগেই গাইবান্ধার প্রগতিশীল বিদ্যানুরাগীরা একটি গালর্স হাইস্কুলের কথা ভেবেছিলেন।
১৯১৬ সালে এমই স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৪১সালে স্কুলটি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান ও অনুমোদন পায়। ফলে ১৯৪২ সালে স্কুলের ছাত্রীরা প্রথমবারের মত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেয়। ১৯৮২ সালের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাজনীন নাজু সারা বাংলাদেশের এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়। আমি সৌভাগ্যবান ১৯৮২-৮৪ শিক্ষাবর্ষে সে আমার সহপাঠি ছিল। গাইবান্ধা সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিল সে। আমরা মানবিক বিভাগের। কলেজের আরেক মেধাবী সহপাঠি সুপ্রীমকোর্টের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী নাহিদ মাহতাব অনু জানালো নাজু এখন স্বামী ও কর্মসূত্রে ইথোপিয়াতে আছে। গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ২০০৩ সালে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাসহ রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছে।
এবার আসি গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি এন্ড ক্লাবের কথায়। ১৯০৭ সালে প্রতিষ্টিত হয় এই লাইব্রেরি ও ক্রীড়া সংগঠনটি। তখনকার মহকুমা প্রশাসককে সভাপতি এবং সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। পরবতীকালে বিভিন্ন সময়ে ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শাহ আব্দুল হামিদ, ডাঃ সাখাওয়াত হোসেন খান, সাইদার রহমান, ফজলার রহমান, শচীন্দ্র কুমার চাকী, লাবণ্য বিকাশ রায় প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি আন্দোলনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি ও ক্লাব।এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় বই, পত্র-পত্রিকা পড়ার জন্য এখানে ভিড় করে শহরের অনেকেই।
আর এখানে উল্লেখিত শাহ আব্দুল হামিদ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় গণপরিষদের প্রথম স্পিকার ছিলেন। তার ছেলে শাহ জাহাঙ্গীর কবীর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে গোবিন্দগঞ্জ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার ছেলে গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র হয়েছিলেন। বৃটিশ আমলে গঠিত গাইবান্ধা পৌরসভাও এ বছর শতবর্ষে পা দিবে।
এরপরই বলতে হয় গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (গানাসাস) কথা। গাইবান্ধার প্রাচীনতম নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যজন তুলসী লাহিড়ী জড়িত ছিলেন এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। তার নামে তাই একটি মঞ্চও করা হয়েছে এখানে। এই সংস্থার মালিকানায় চৌধুরী টকিজ আমাদের তারুণ্যে সিনেমা দেখার দুটি হলের একটি। পরে হয়েছিল নুপুর সিনেমা। আর এবার দেখি মায়া হলের বিলুপ্তি ঘটেছে। সেখানে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল সুপার মার্কেট।
তিনটি স্কুল আর দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ পাঁচটি শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান জানান দেয় কতটা অগ্রসরমান এই শহরটি। গত দুটি বছর যখন এই বিষয়ে কাজ করছি তখনই নজরে এলো যে শহরের নাগরিক সেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত গাইবান্ধা পৌরসভাও শতবর্ষে পা দিবে ২০২৩ সালে। অনুজপ্রতিম মাতলুবুর রহমান এখন পৌর মেয়র। খুবই আনন্দের সাথে তাকে অনুরোধ করেছি বড় আকারে শতবষ উদযাপনের আয়োজন করার জন্য।
ইতিহাসে তথ্য বলছে গাইবান্ধা শহরের গোড়াপত্তন হয় বিগত ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে। এর আগে গাইবান্ধা নামে কোন শহর ছিল না। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে পাতিলাদহ পরগনার ভবানীগঞ্জ মৌজায় ৯৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে সর্বপ্রথম ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে ২৭আগষ্ট ভবানীগঞ্জ মহকুমা নামে একটি মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হলে মহকুমা শহরটি জরুরীভিত্তিতে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ভবানীগঞ্জ থেকে ১২কিমি পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীরে এই গাইবান্ধা নামক স্থানে মহকুমা শহরটি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্থানান্তরিত হয়। নতুন স্থানের নামানুসারে তখন থেকেই ভবানীগঞ্জ মহকুমার নাম পরিবর্তন হয়ে গাইবান্ধা মহকুমা হয়। কথিত আছে যে, ৫ হাজার বছর পূর্বে মহাভারতখ্যাত মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানায়। রাজা বিরাটের ৬০ হাজার গাভী ছিল।এই গাভীদের গো-চারণভুমি এবং গো-শালা ছিল বর্তমান গাইবান্ধা পৌর এলাকাজুড়ে। সেই গাইবাঁধা এলাকা থেকে স্থানের নামকরণ হয়েছে গাইবান্ধা।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে গাইবান্ধা শহরটির আয়তন ছিল ২.৩৩ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল ১,৬৩৫ জন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেস্বর পর্যন্ত গাইবান্ধা শহর এলাকায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু ছিল। বৃটিশ সরকারের পৌরপ্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার পরিপ্রেক্ষিতে মহকুমা শহরগুলোতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পরিবর্তে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে পৌরপ্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। গাইবান্ধা শহরবাসীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবর গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠা করে।
গাইবান্ধার শিক্ষা-সংস্কৃতির যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আছে, তার বড় প্রমাণ এসব শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান। আরো বড় বিষয় যে মাত্র ২/৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই এগুলোর অবস্থান। যেটা একটি শহরের জন্য অতি অবশ্যই গৌরবের বিষয়।
এমন একটি শহরের সকল নাগরিকের জন্য তা এক অহংকারও বটে। খুব আন্তরিক ইচ্ছা আমরা এই অহংকারটা উদযাপন করি। আর এর দায়িত্ব এখন যারা গাইবান্ধা শহরের বসবাস করেন, তাদের নয়, বরং আমরা যারা এই শহরের আলো-হাওয়ায় বড় হয়েছি তারাও যেন সেই অহংকার উদযাপনে শরিক হই। দেশে-বিদেশে যারা আছেন গাইবান্ধার মানুষ, তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী, সবাই মিলে আসুন এক হই, তুলে ধরি অহংকার আর গৌরবের গাইবান্ধাকে।
লেখক: সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ টিভি