- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ১৪-১০-২০২২, সময়ঃ বিকাল ০৩:২৬
গোবিন্দগঞ্জের নয়ারহাটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার শীতবস্ত্র
মনজুর হাবীব মনজু, মহিমাগঞ্জ ►
শীত আসতে এখনও বেশ বাকী। কিন্তু শরৎ শেষে হেমন্তের আভাস নিয়ে আকাশে-বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ার আগেই জমতে শুরু করেছে উত্তরের গ্রামীণ জনপদে গড়ে ওঠা কুটির শিল্প এলাকা কোচাশহরের নয়ারহাটের শীতবস্ত্রের বেচাকেনা। যোগাযোগ, টেলিফোন আর বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সুবিধা বঞ্চিত এ জনপদের প্রত্যয়ী মানুষদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা শীতবস্ত্র তৈরীর কুটির শিল্পাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র এ বাজারটিতে এখনই প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার নানা প্রকার শীতবস্ত্র। করোনা পরিস্থিতিতে বিগত দুই বছরের লোকসান কাটাতে এ মৌসুমে নবোদ্যমে উৎপাদন ও বিক্রির জন্য প্রস্তুত গোবিন্দগঞ্জের হোসিয়ারিপল্লী কোচাশহরের নয়ারহাট।
একদার মঙ্গাপীড়িত উত্তরাঞ্চলের অন্ধকার ছোট্ট এই জনপদটি এখন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শীতকে সামনে রেখে দেশের সর্বমোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্র উৎপাদনকারী এ এলাকার ব্যবসায়ীরা চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিগত দুই বছর উৎপাদন ও বিপণনে সৃষ্ট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি শীত মৌসুমে এখানে উৎপাদিত শীতবস্ত্র বিক্রি পাঁচশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা। গত এক মাস ধরে দেশের প্রায় সকল এলাকা থেকে আসা শত শত ছোট-বড় ব্যবসায়ী এখান থেকে কিনতে শুরু করেছেন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ সকল বয়সী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকারের শীতবস্ত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ শীতবস্ত্রের বাজারে নিরাপদে কেনাকাটা করে ট্রাক-বাস-পিকআপ-ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে এ সব মালামাল নিয়ে ব্যবসায়ীরা ছড়িয়ে পড়ছেন সারা দেশে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হলেও এখানে কোন প্রকার পুলিশ বা প্রশাসনিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই সম্পুর্ণ নিরাপদে টাকা এবং মালামাল বহন করতে পারায় দূর-দুরান্তের ব্যবসায়ীদের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এখানকার উৎপাদিত শীতবস্ত্রের প্রতি। সরকারী সহায়তা ছাড়াই কেবল নিজেদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কর্মদ্যোমকে কাজে লাগিয়ে একেবারেই অন্ধকার একটি পল্লী অঞ্চলকে ব্যবসাসফল অবস্থায় স্থাপন করে আলোয় ভরিয়ে দিয়েছেন এখানকার ক্ষুদ্র কুটির শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও কারিগররা। এ যেন বাংলাদেশের মধ্যে ছোট্ট একটি চীন, জাপান বা ইউরোপের উন্নত শিল্পপ্রধান কোন এলাকা। নিজেদের প্রচেষ্টায় এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে স্থাপিত ছোট ছোট কারখানার সমন্বয়ে কুটির শিল্পের জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এ এলাকাটি।
কোচাশহর নামক ছোট্ট একটি এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কুটির শিল্পাঞ্চলের প্রধান বিপণনকেন্দ্র এ বাজারটির অবস্থান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া গ্রামের নয়ারহাট। নয়া মিয়া সরকার নামের একজন উদ্যোক্তার ব্যাক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছোট্ট বাজারটি এখন সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে শীতবস্ত্রের পাইকারী বাজার হিসেবে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, পাকিস্তান শাসনামলের প্রথম পর্যায়ে এই পেপুলিয়া গ্রামেরই স্বপ্নবাজ এক যুবকের হাত ধরে এখানে গোড়াপত্তন হয় হোসিয়ারী শিল্পের। মোজা তৈরীর ছোট্ট দুটি হাত মেশিনের সূত্র ধরে এখানকার মানুষ পথ দেখেন শুধু কৃষিজমিতে ফসল ফলানো, মাছ ধরা বা কুলি- মজুরের কাজ নয়- অন্যধরনের কাজ বা ব্যবসা করেও জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি অনেক বড় কিছু করার।
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পূর্ব দিকে চলা রংপুর চিনিকলসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলখ্যাত মহিমাগঞ্জ সড়কের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত কোচাশহর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম পেপুলিয়া। এ গ্রামেরই এক যুবক আব্দুর রহিম ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীণ পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় গিয়ে এক মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর মোজা কারখানায় কাজ করতেন। বৃটিশ শাসনামলের শেষ পর্যায়ে দেশ ভাগের কারণে ওই মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী ভারতে চলে যাওয়ার সময়ে আব্দুর রহিমকে দান করে যান দুটি মোজা তৈরির ছোট্ট হস্তচালিত মেশিন আর সামান্য কিছু সুতো। এ নিয়েই বাড়ি ফিরে মোজা তৈরী করে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে প্রসার ঘটে তার এ ব্যবসার। উন্নয়ন ঘটে তার ভাগ্যের। এখানে কাজ শিখে নিজেরাও মেশিন কিনে মোজা তৈরী এবং বিক্রি শুরু করেন এখানকার আরও অনেকে। পাকিস্তান আমলেই এ জনপদ পরিচিতি পায় কুটির শিল্পের এলাকা হিসেবে। তখন কেবল সুতি সুতোয় হস্তচালিত মেশিনে বোনা হাত ও পায়ের মোজা শীতকালে আশপাশের হাটবাজারগুলোতে বিক্রি করতেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে উন্নত মেশিন ও উলেন সুতা আমদানী সহজ হলে এখানকার উদ্যোক্তারা শুরু করেন মোজার পাশাপাশি মাফলার, সুয়েটারসহ কয়েকটি আইটেমের শীতবস্ত্র তৈরীর কাজ। কালক্রমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে উৎপাদন হতে থাকে সর্বাধুনিক ডিজাইনের বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র। বর্তমানে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এখানকার তৈরি নারী-পুরুষ-শিশুদের সব ধরণের শীতবস্ত্র যে কোন দেশের পোষাকের সাথে পাল্লা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে জানালেন লাবিব হোসিয়ারির মালিক তরিকুল ইসলাম। বিশ^বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া এই উদ্যোক্তা জানান, এ এলাকার শতাধিক কারখানায় অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি শীতবন্ত্র এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের নামকরা শো-রুমে বিক্রি হচ্ছে।
এখানকার উদ্যোক্তরা জানান, বর্তমানে দেশের চাহিদার একতৃতীয়াংশ শীতবস্ত্রের যোগান দেন কোচাশহরের নয়ারহাট কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া, বনগ্রাম, কানাইপাড়া, ধারাইকান্দি, রতনপুর, শক্তিপুর, ছয়ঘরিয়া, আরজী শাহাপুর, পার্শ্ববর্তী মহিমাগঞ্জ, পুনতাইড়, কুমিড়াডাঙ্গা, গোপালপুর, শিবপুর, কামারদহ এবং বগুড়া জেলার সৈয়দপুর, সোনাতলা, বালুয়াহাটসহ চারিদিকের অর্ধশতাধিক গ্রামে গড়ে ওঠা শীতবস্ত্র তৈরীর অর্ধসহ¯্রাধিক ছোটবড় কারখানায় প্রতিবছর উৎপাদিত হচ্ছে আড়াই থেকে তিনশ’ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র। বর্তমানে কোচাশহর, গোবিন্দগঞ্জ, ধারাইকান্দি, রতনপুরসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় এখানকার উৎপাদিত শীতবস্ত্র বিক্রির বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বাজার স্থাপিত হলেও কেবলমাত্র নয়ারহাটেই এখন প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড় কোটি টাকার শীতবস্ত্র। আগামী নভেম্বর মাস থেকে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় কোটিতে গিয়ে পৌঁছুবে বলে আশা করছেন তাঁরা। প্রতিনিয়তই অত্যাধুনিক ডিজাইনের সকল প্রকার শীতবস্ত্র তৈরীতে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছেন এখানকার কুটির শিল্পীরা। সর্বাধুনিক মেশিন স্থাপন করা হয় প্রতি বছরই। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরীও করছেন স্থানীয় কারিগররা। এখানে স্থাপিত বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় বিদেশ থেকে আমদানী করা মেশিনের অনুরূপ মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরী করে অনেক কমদামে সরবরাহ করা হয়। দেশে তৈরী সুতা ছাড়াও বর্তমানে এখানকার একাধিক ব্যবসায়ী এলসির মাধমে ভারত ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি সুতা, নিটিং মেশিন ও প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করছেন। সম্প্রতি এখানকার বেশ কয়েকজন মালিক অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড মেশিন আমদানি করে তাতে উৎপাদণ শুরু করেছেন উন্নতমানের শীতবস্ত্র।
চলাচলের অযোগ্য ভাঙ্গাচোরা রাস্তা পেরিয়ে গতকাল শুক্রবার ওই হাটে গিয়ে দেখা গেলো সেখানকার বাস্তব চিত্র। ছোটবড় দুই শতাধিক দোকানে এখন চলছে পুরোদমে বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা ঘুরে ঘুরে কিনছেন তাদের প্রয়োজনীয় নানা প্রকারের শীতবস্ত্র। কথা হলো রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ব্যবসায়ী আবু হেনার সাথে। তিনি জানালেন, কমদামে উন্নতমানের শীতবস্ত্র কিনতে তিনি প্রতি বছরই এখানে আসেন। ফরিদপুরের ব্যবসায়ী সুশীল দেবনাথ বললেন, রাস্তার বেহালদশার কষ্ট ভুলিয়ে দেয় এখানকার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ও আতিথেয়তা। সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে আসা কাপড় ব্যবসায়ী রুবেল আহমেদ, কুড়িগ্রামের আব্দুর রউফ ও জামাল উদ্দিন জানালেন, দিন বা রাতের যেকোন সময় এখানে টাকা পয়সা নিয়ে নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তা খুব বড় স্বস্তির ব্যাপার।
নয়ারহাট হোসিয়ারী শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান সরকার অভিযোগ করলেন, বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিয়েও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরে যাতায়াতের জন্য কোচাশহর পর্যন্ত রাস্তাটি মেরামত করানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বিদ্যুত সমস্যার পাশাপাশি কোন মোবাইল ফোনের টাওয়ার না থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। রাস্তার কারণে বড় গাড়ী এখানে আসতে না পারায় মালামাল ভ্যান বা ছোট পিকআপে করে কোচাশহরে নিতে দ্বিগুন খরচ এবং চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নয়ারহাটের শীতবস্ত্র প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা তিন বোন হোসিয়ারির মালিক মশিউর রহমান জানান, এখানে কোন ব্যাংক না থাকায় টাকা লেনদেন সুবিধাবঞ্চিত হয়ে আছেন এখানকার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ক্ষুদ্র মালিকরা বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। নয়ারহাট বাজারের স্বপ্নছোঁয়া বোতাম ও সেলাইঘরের মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সারা বছর ধরে উৎপাদিত শীতবস্ত্র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। চলতি বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় তীব্র শীত হওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই এবার ব্যবসাও ভালো হবে বলে আশা করছেন তারা।
কোচাশহরের মানুষের স্বউদ্যোগে গড়ে তোলা কুটির শিল্পকে সরকারী স্বীকৃতির পাশাপাশি অবিলম্বে এখানকার প্রয়োজনীয় রাস্তাগুলি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ প্রধান।