- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ২৭-১১-২০২৩, সময়ঃ রাত ০৭:৫৯
গাইবান্ধায় শিক্ষা বঞ্চিত বেদে শিশু
মোঃ মেহেদী হাসান►
গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলসীঘাট হেলিপ্যাড মাঠে অস্থায়ীভাবে বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস। পূর্বপুরুষের পেশাগত কারণে এই সম্প্রদায় সামাজিকভাবে অবহেলিত। আর অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানরা। তাদের কোনো স্থায়ী আবাস না থাকায় বিদ্যালয়েও চোখে পড়ে না বেদে শিশু।
একজন কোমলমতি শিশুর হাতে যখন বই-খাতা থাকার কথা, তখন বেদে শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় সাপের বাক্স। বেরিয়ে পড়তে হয় পরিবারের আহার জোটাতে। কম বয়সেই ঝুঁকি নিয়ে সাপ, বাঁদর খেলার মতো পেশায় জড়িয়ে পড়তে হয় বেদে শিশুদের। তাদের কাছে শিক্ষা বলতে সাপ ও বাঁদর খেলা শেখা। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার সুযোগ নেই তাদের। হাট-বাজারে সাপ, বাঁদর খেলায় মা-বাবাকে সহযোগিতা করাই তাদের মূল কাজ।
সরেজমিনে গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলসীঘাট হেলিপ্যাড মাঠে অস্থায়ীভাবে বেদে সম্প্রদায়ের বসবাসরত দেখা গেছে, পলিথিন ও কাপড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী বেদে পল্লি। গাইবান্ধা জেলার সদর উপজেলার তুলসীঘাট হেলিপ্যাড মাঠে প্রায় দেড়মাস ধরেই শতাধিক বেদে পুরুষ, নারী, শিশু জড়ো হয়েছে এখানে। এখানে নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা। ভেজা ঘাস মাটির ওপর বিছানা করে রাত যাপন করছে ভ্রাম্যমাণ বেদে পল্লির মানুষ।
বেদে পল্লির শিশু সাহারা বলে, কোনোদিন স্কুলে যাইনি, গ্রামের ছেলে মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখে আমারও স্কুলে যেতে মন চায়। আমাদের বেদে পল্লির ছেলেমেয়েদের কেউ স্কুলে যেতে বলে না। ভোর হলেই আমরা বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামের পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াই। গ্রামের শিশুদের খেলা দেখাই। লেখাপড়া করে আমরা অন্য পেশায় কাজ করতে চাই। বেদেনী খোদেজা বেগম বলেন, বেদে শিশুদের পড়াশোনার আগ্রহ থাকলেও এদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে আসে না।
বেদে সর্দার আশরাফুল ইসলাম বলেন, সারা দিন গ্রাম ঘুরে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই আমাদের সাহায্যের জন্য শিশুদের নিয়ে যাই। এখন থেকেই তাকে পেশাগত সব বিষয় জানতে হবে। নইলে বড় হয়ে কী করে খাবে তারা। তিনি দুঃখ করে আরও বলেন, জেলখানায়ও খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। যা বেদেদের নেই। শহরে এখন আমাদের আদিম চিকিৎসা চলে না। আমরা গ্রাম-গঞ্জে পরিবার নিয়ে ভিক্ষা করার মতো চেয়ে চিন্তে খাবার খাই।
বেদে পল্লির আরেকজন আলাল সর্দার বলেন, কোনো অভিভাবক চায় না তার সন্তান অশিক্ষিত থাকুক। কিন্তু আমাদের যে আয় তাতে সন্তানদের পড়াশোনা চালানো কঠিন। আমাদের ২৫টি পরিবারে মোট ২৯ জন শিশু রয়েছে। এদের ১৫ জনেরই বয়স ৭ বছরের ওপরে। তারা কেউ স্কুলে যায় না। নিজের নামটাও লিখতে পারে না তারা। সরকারিভাবে ব্যবস্থা নিলে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দিতে পারতাম।
সৃজনশীল গাইবান্ধা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মো. নিশাদ বাবু তুলসীঘাট অস্থায়ী বেদে পল্লিতে যায় তিনি জানায়, ওখানে গিয়ে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমরা বিস্মিত হই। বিভিন্ন বয়সী শিশুদের মধ্যে একটি শিশুকেও পাওয়া গেল না যে স্কুলে লেখাপড়া করে। এর কারণ হিসেবে বেদে সম্প্রদায়ের কেউ কেউ বললেন, দীর্ঘদিন তাঁরা এক জায়গায় থাকেন না। জলে ভাসা শেওলার মতো তাঁদের জীবন। তাই সন্তানদের স্কুলে ভর্তির বিষয়ে তাঁরা আগ্রহী নন। আর সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, বেদে সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকজনই মনে করেন, স্কুলে ভর্তি হতে টাকা লাগে, মাসে মাসে মায়না (বেতন) লাগে। তাঁরা জানেন না সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে কোনো টাকাপয়সা লাগে না। বরং সরকার উপবৃত্তি নামে প্রতি মাসে কিছু টাকা দেয়, বিনা পয়সায় বই দেয়, বছরের শুরুতে স্কুল ইউনিফর্ম, জামা-জুতা কিনতে এককালীন কিছু টাকা দেয়।
গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক মো. রাশেদ মিয়া বলেন, বেদে সম্প্রদায় দেশের নাগরিক। শিক্ষাগ্রহণ একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বেদে পল্লির শিশুদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার দরকার। তারা অন্যত্র চলে গেলে সেই স্থানের স্কুলে ভর্তি করে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এই শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাকিরুল হাসান বলেন, প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে শিশুদের জরিপ করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো শিশু যেন পড়াশোনা থেকে বাদ না পড়ে আমরা সেদিকে খেয়াল রাখি। বেদেরা যেহেতু নির্ধারিত এলাকায় বসবাস করে না এজন্য তাদের সন্তানদের পড়াশোনা হয় না। তবে তিনি বেদেদের প্রতি আহ্বান জানান তারা যেন সন্তানদের লেখাপড়া করার সুযোগ করে দেয়।