- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ৬-১১-২০২৪, সময়ঃ সকাল ১০:৩৪
গাইবান্ধা জেলার উন্নয়ন উপাখ্যান
কে এম রেজাউল হক►
স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য নাকি অবহেলা এই প্রাচীন অবহেলিত গাইবান্ধা জেলা পূর্ব অবস্থাতেই রয়ে গেল। ৫ দশকের দীর্ঘ পরিক্রমায় তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের ছোঁয়া গাইবান্ধা পায়নি। কেন পায়নি এই প্রশ্নটি প্রত্যেকের কাছে।
কখনো মনে হয় আমরা গাইবান্ধাবাসীরা কি উদ্বাস্তু নাকি ভিনদেশের কোনো অভিবাসী। গাইবান্ধার উন্নয়নে কারোই যেন কোনো মাথা ব্যথা নাই। অজস্র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আছে, আছে সুশীল সমাজ, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, সরকারি কর্মকর্তা এই একটি বিষয়ে কেন যেন সবারই দায়সারা উদাসীন ভাব। স্বাধীনতা পরবর্তী এ যাবতকাল পর্যন্ত অসংখ্য সাংসদ, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন এবং অনেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কেউ গাইবান্ধার উন্নয়নে তেমন জোড়ালো ভূমিকা রাখেন নাই। সেই পাকিস্তান শাসন আমলেও আমরা বলেছি অনুন্নত গাইবান্ধা আজও সেই একই কথা বলছি। তবে এটি পরিষ্কার নিজেরা যদি জেলার উন্নয়ন ঘটাতে না পারি তবে অন্য কেউ এসে এই জেলাকে স্বর্গতুল্য করে দেবে এটি দূরাশা।
বৃহত্তর রংপুর জেলার নির্বাচনী এলাকা ছিল সাদুল্লাপুর। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে গাইবান্ধা মহকুমা থেকে জেলার মর্যাদা লাভ করে। সেই সুবাদে সাদুল্লাপুর গাইবান্ধার অধীনে আসে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ৭ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ সাদুল্লাপুর নির্বাচনী এলাকাটি পলাশবাড়ীর সাথে একিভূত করে সাদুল্লাপুর নির্বাচনী এলাকাটি অন্যত্র স্থানান্তর করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য গাইবান্ধার কোনো নেতা এক্ষেত্রে তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেননি। আমার স্মরণ আছে সে সময় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবু তালেব ভাই কিছুদিন সোচ্চার ছিলেন। উনি প্রায়ই আমার কাছে আসতেন বিষয়টি নিয়ে লিখতে অনুরোধ করতেন যাতে সিদ্ধান্তটি বাতিল করা হয়। তিনি ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে বলেন, এত বড় একটা ঘটনা এর প্রতিবাদে কারো কোনো ভূমিকা দেখছি না। পরবর্তীতে দেখা গেল আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পাঁচ আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর এবং জেলা হওয়ার চল্লিশ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে কিন্তু আজ অব্দি গাইবান্ধা জেলাকে আমরা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদায় উন্নীত করতে পারিনি। আমরা এখনো দ্বিতীয় শ্রেণীর জেলা হিসাবে পরিগণিত। শুধুমাত্র আরেকটি উপজেলা করা গেলে গাইবান্ধাকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটানো যায়। এই কাজটি ৪০ বছরে কোনো সাংসদ বা নেতা করতে পারেন নাই।
গাইবান্ধার সার্বিক উন্নয়নে জনগণের আগ্রহের কমতি নাই। শুধু মানববন্ধন আর দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হলেই যে সমস্যার সমাধান হয় না তার তিক্ত অভিজ্ঞতা জনগণের আছে। জেলার উন্নয়নে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যদি সাংসদ বা নেতাদের দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা না থাকে তবে কস্মিনকালেও উন্নয়ন সম্ভব নয়।
গাইবান্ধায় একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন অত্যাবশ্যকীয় এবং এটি জনদাবি। শুধু গাইবান্ধাবাসীর জন্য নয়, ভৌগোলিকভাবেও এতদঅঞ্চলের জনগণের চিকিৎসা সেবার জন্য মেডিকেল কলেজ স্থাপন জরুরি। মুমূর্ষু রোগী তা যে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হোক তাকে যখন নিবিড় পরিচর্যা দরকার তখন আমরা মূল্যবান সময় নষ্ট করে হয় রংপুর বা বগুড়া মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করার চেষ্টায় গলদঘর্ম হই, আবার এর কোনো বিকল্পও থাকে না। কাজেই রংপুর-বগুড়ার মাঝে গাইবান্ধায় একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন কতটা জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিগত পতিত সরকারের রাজত্বে আমরা দেখেছি উত্তরাঞ্চলে একটি মেডিকেল কলেজ, একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও আমাদের ভাগ্যের ছিঁকে ছেড়েনি। বিগত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরা ছিলেন গাইবান্ধার পাঁচ নির্বাচনী এলাকায়। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন একজন ডেপুটি স্পিকার এবং একজন জাতীয় সংসদের হুইপ।
কিন্তু দেখা গেল মেডিকেল কলেজটি স্থাপিত হলো নীলফামারীতে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গেল কুড়িগ্রামে এবং দুইটি সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থাপিত হলো নওগাঁয় অন্যটি ঠাকুরগাঁওয়ে। গাইবান্ধার ভাগ্যে ওই অবহেলিত থাকার তকমা অব্যাহত থাকলো। এসব দেখেও আমাদের মাননীয় সাংসদবৃন্দ এমন নির্বিকার ভূমিকায় থাকলেন যেন তারা এই জেলার কেউ নন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে গাইবান্ধা জেলায় প্রায় ৬০ জন সাংসদ বিভিন্ন সময়ের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা জেলার জনগণ কখনো দেখি নাই গাইবান্ধার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে পাঁচ সংসদকে এক টেবিলে বসতে কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোনো যৌথ উদ্যোগ নিতে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, নিজ নিজ জেলার উন্নয়নের প্রশ্নে সব সাংসদই একাট্টা। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম; আমাদের সাংসদ মহোদয়দের মধ্যে কেন জানি একটা বৈরি সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সংকীর্ণমনতার উর্ধ্বে আমরা ঠিক কবে উঠব এ ব্যাপারে তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক অবস্থার প্রতিফলন আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে কি তা জনগণের বোধগম্যের বাহিরে।
শুধু সংসদ বা নেতারাই নন, গাইবান্ধার যাতে কোন উন্নতি না হয় সেজন্য জনগণের একটি পক্ষ সবসময় বিরোধিতা করে আসবে এটিই যেন আমাদের নিয়তি। গাইবান্ধা একটি মাত্র ভারী শিল্প রংপুর সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিকল্প হিসেবে সরকার মিলের পরিত্যক্ত কৃষি খামারে একটি ইপিজেড স্থাপনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু এতে বাধ সাধে একটি পক্ষ; তাদের বক্তব্য এখানে কিছুতেই ইপিজেড করা যাবে না। কারণ এই জায়গায় একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে পুনর্বাসিত করতে হবে। অদ্ভুত সেলুকাস চিন্তা-চেতনার কি নির্মম অবক্ষয়। জেলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আসবে, গাইবান্ধা শহর আশপাশের জেলার দুই থেকে তিন লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে এসব কোনো বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের সামান্য কিছু গোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করতে হবে। নিজেরাই যখন উন্নতি চায় না সেক্ষেত্রে সরকার বা কর্তৃপক্ষের এমন কোনো দায় পড়েনি যে লাঠিপেটা করে উন্নয়ন করতে হবে। অতএব ইপিজেড বিষয়টি ঝুলে থাকলো এবং ইতোমধ্যে অন্যান্য জেলা তাদের এলাকায় এটি স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেছে। আমরা যদি নীলফামারীর মতো একটি বন্ধ্যা জেলার দিকে দেখি সেখানে ইপিজেড স্থাপনের পর ওই জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বেড়েছে; সেইসঙ্গে বেড়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
যা হোক গাইবান্ধায় শিক্ষা, বিনোদন, পর্যটন ক্ষেত্রে যে যৎসামান্য উন্নয়ন লক্ষণীয় তাও বেসরকারি খাতে এবং স্থানীয় এনজিওদের কল্যাণে।
অতএব এই ৫৩ বছরের পিছিয়ে থাকার ঘাটতি সহসা পূরণ সম্ভব নয় তবে আমাদের চৈতন্য উদয় এখন সময়ের দাবি। দলমত নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের জনগণকে গাইবান্ধার উন্নয়নের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নাই। সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উন্নয়নের রুপরেখা অনুমোদনের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্তত বর্তমান প্রজন্মের জন্য না হলেও পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুফল ভোগ করতে পারে এবং আমাদের দায়িত্ব অবহেলার দায়ে অভিসম্পাত না করে।